সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত দুর্বল, শাস্তি নিয়ে সংশয়

সাজ্জাদ মাহমুদ খান
০৩ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত দুর্বল, শাস্তি নিয়ে সংশয়

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। রাজধানীর বাড্ডায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কে সরকারবিরোধী ছাত্র-জনতার মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন আল-আমিন। সে সময় আন্দোলনকারীদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এতে প্রাণ হারান এই তরুণ। সুরতহাল প্রতিবেদন ও ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয় তার লাশ; মৃত্যুসনদও নেননি স্বজনরা। পিতৃমাতৃহীন আল-আমিন হত্যার ঘটনায় মামলা করেন তার চাচা রহমান মাল। এ মামলার তদন্তকালে তদন্ত কর্মকর্তা গুলি চালানোর কোনো সিসি ক্যামেরা ফুটেজ কিংবা অন্য কোনোভাবে ধারণ করা কোনো ভিডিও ফুটেজও সংগ্রহ করতে পারেননি।

শুধু আল-আমিনের ক্ষেত্রেই নয়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে নিহত ছাত্র-জনতার একটি বড় অংশেরই লাশ দাফন করা হয়েছে ময়নাতদন্ত ছাড়া। সুরতহাল প্রতিবেদনও তৈরি করেনি থানা পুলিশ। মৃত্যুসনদও সংগ্রহ করা হয়নি। এর ফলে ঝুলে যাচ্ছে তদন্ত। মামলার অভিযোগ প্রমাণে যেসব আলামত বা সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রয়োজন, তা উদ্ধারে হিমশিম খেতে হচ্ছে তদন্ত কর্মকর্তাদের। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত দুর্বল হওয়ার কারণে এসব হত্যাকাণ্ডের মামলায় অপরাধীদের শাস্তি নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সংশয়, অনিশ্চয়তা।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ঘটনাস্থল ও আশপাশে যেসব সংস্থার সদস্য ডিউটিরত অবস্থায় ছিলেন, তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। বিশেষ করে পুলিশ, বিজিবি, র‍্যাব ও সেনাবাহিনীর তৎকালীন ডিউটি চার্ট সংগ্রহ করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। মাঠের কর্মকর্তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদের তথ্য সংগ্রহে আবেদন করা হয়েছে। নিহতের মৃত্যুসনদ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সনদ সংগ্রহ করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। নিহতের ছবি, ভিডিও ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহেরও জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন।

সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরশেদ গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, এফআইআরে লেখা হলো গুলি করা হয়েছে। কিন্তু ময়নাতদন্তে যদি পাওয়া যায় কুপিয়ে মারা হয়েছে তাহলে মামলা মিথ্যা হয়ে গেল। আমাদের প্রচলিত ফৌজদারি ব্যবস্থায় ময়নাতদন্ত না থাকলে মামলার প্রমাণ হবে কীভাবে? সেক্ষেত্রে ময়নাতন্ত ও সুরতহাল রিপোর্টের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, মামলা প্রকৃত ব্যক্তিরা করেনি; করেছে কিছু ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তি। কয়েকশ জনকে আসামি করেছে। যার ছেলে মারা গেছে, তিনি মামলা করলে এমন হতো না।

প্রবীণ এই আইনজীবী বলেন, এখন তো উত্তরণের সহজ কোনো উপায় দেখা যাচ্ছে না। মামলাগুলো বিচারের জন্য করা হয়নি। রাজনৈতিক হয়রানির জন্য করা হয়েছে। যারা মারা গেছে তাদের আত্মীয়স্বজনরা তো এই মামলায় বিচার পাবে বলে মনে হয় না। মামলা হয়রানির জন্য করা হয়েছে, হয়রানিই হবে। বিচার হবে না।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় ৪৬টি হত্যা মামলার তদন্ত করছে সংস্থাটি। এসব মামলার তদন্তে দেখা গেছে, মাত্র ১২টি হত্যাকাণ্ডের ময়নাতদন্ত হয়েছে। অবশিষ্ট ৩৪টি মামলায় ভিকটিমের মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়েছে। শ্যোন অ্যারেস্টসহ পিবিআই এ পর্যন্ত ২১৫ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। এটি হচ্ছে দায়ের হওয়া মামলার এজাহারভুক্ত আসামির মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ। যদিও পিবিআই বলছে, তাদের কর্মকর্তারা মামলাগুলোর ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ তদন্তের কাজ ইতোমধ্যেই শেষ করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক পরিদর্শক আমাদের সময়কে বলেন, হত্যার সময় ঘটনাস্থলে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাসহ প্রত্যেকের মোবাইল ফোনের কল ডিটেইল রেকর্ড (সিডিআর) সংগ্রহ করা হয়েছে। আদালতের অনুমতি নিয়ে মোবাইল কোম্পানির কাছ থেকে এ তথ্য নেওয়া হয়েছে। এতে ঘটনার সময় আসামির অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। সেই সঙ্গে ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত ভিডিও সংগ্রহের জোর চেষ্টা করছেন তিনি। গুলি কিংবা হত্যার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করতে পারলে অপরাধীদের দোষী প্রমাণের কাজটি সহজ হবে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সংঘটিত হত্যা মামলার তদন্তের বিষয়ে পুলিশের শীর্ষ এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা ডিজিটাল তথ্য-প্রমাণের পাশাপাশি প্রত্যক্ষ সাক্ষী খুঁজে বের করার জোর চেষ্টা চালাতে তদন্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। এ জন্য ঘটনাস্থল এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত সমন্বয়কদের সহযোগিতা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। সমন্বয়কদের সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও ঘটনার সাক্ষী খুঁজে বের করবেন তদন্ত কর্মকর্তারা। আসামিদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা এবং রিমান্ডে এনে তথ্য সংগ্রহ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, নিহতের জানাজার ইমাম ও গোসল করানো ব্যক্তিদের সাক্ষ্য নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে ভিকটিমের মৃত্যুসনদ সংগ্রহ করতে হবে। নিহতের সহযোদ্ধা ও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে তাদের সাক্ষ্য নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণ-অভ্যুত্থানের সময় নিহতদের অধিকাংশ আলামতই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আসামিদের দোষী প্রমাণের পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করাও কঠিন। এ ছাড়া সাক্ষী হতে অনেকেই অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। ফলে তদন্তের ক্ষেত্রে এখন মোবাইল ফোনের সিডিআর, গণমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিও ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজসহ ডিজিটাল প্রমাণের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে। তদন্তের ফাঁকফোকর বন্ধ করতে অভিজ্ঞ আইনজীবীদের সহযোগিতাও নেওয়া হচ্ছে। তদন্ত কর্মকর্তারা আইনজীবীদের পরামর্শ নিচ্ছেন যেন মামলার চার্জশিট দেওয়ার পর বিচারের সময় কোনোভাবেই দোষীরা আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে না পারে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রসিকিউটোরিয়াল উপদেষ্টা ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, একটা মামলার প্রমাণ হয় সরাসরি তথ্য-প্রমাণের মাধ্যমে এবং পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে। যেসব মামলায় সরাসরি প্রমাণ নেই, সেসব মামলায় আমাদের পারিপাশির্^ক সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করতে হবে। জুলাই হত্যামামলার ডিজিটাল প্রমাণও আছে। তথ্য-প্রমাণ বের করেই মামলার চার্জশিট দিতে হবে।

এসব হত্যাকাণ্ডের হুকুমদাতাদের বিষয়ে পেনাল কোডের ১০৭ ধারার কথা উল্লেখ করে এহসানুল হক সমাজী বলেন, প্ররোচনার অভিযোগে তারা অভিযুক্ত হবেন। তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেলে মূল অপরাধীর সঙ্গে প্ররোচনাকারীদের অপরাধের বিষয়টি চলে আসবে। আমরা তদন্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশনা ও পরামর্শ দিচ্ছি, অন-ম্যারিটে চার্জশিট দিতে হবে। পক্ষপাতহীন তদন্তের গুণাগুণের ভিত্তিতে চার্জশিট দেওয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে।