রপ্তানিতে আশা জাগাতে পারছে না পাট খাত

রেজাউল রেজা
০২ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
রপ্তানিতে আশা জাগাতে পারছে না পাট খাত

বিশ্ববাজারে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও রপ্তানিতে বারবার হোঁচট খাচ্ছে দেশের পাট ও পাটজাত পণ্য। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও এ খাতে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি আগের অর্থবছরের চেয়ে কমেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে পাটে রপ্তানি আয় এসেছে ৮২ কোটি ১ লাখ ৬০ হাজার ডলার। আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে তা ৪ দশমিক ১০ শতাংশ কম। এ সময় পাটের তৈরি ব্যাগ ও বস্তা ছাড়া অন্য সব পণ্যের রপ্তানি কমেছে। পাটের এমন দুর্দিনে রপ্তানিকারকরাও হতাশ। তারা বলছেন, রপ্তানিতে বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। যথাযথ নীতি সহায়তার অভাবেও পিছিয়ে পড়ছে গুরুত্বপূর্ণ এ খাত।

সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড ১১৬ কোটি ১৪ লাখ ডলারের রপ্তানি আয়ের দেখা পায় পাট। এ আয় আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩১ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি ছিল। এ সময় রপ্তানিতে দেশের শীর্ষ খাতগুলোর তালিকায় চামড়াকে হটিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে পাট। এরপর থেকেই পতন ঘটতে থাকে, যা আর টেনে তোলা সম্ভব হয়নি। টানা চার বছর ধরে রপ্তানি আয় কমতে কমতে এখন বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।

ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, পরের বছর অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি আয় ৩ শতাংশ কমে ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ডলারে নেমে আসে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ১৯ দশমিক ১৭ শতাংশ কমে ৯১ কোটি ১৫ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ কমে রপ্তানি দাঁড়ায় ৮৫ কোটি ৫২ লাখ ডলার। সদ্যসমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও রপ্তানি ৪ দশমিক ১০ শতাংশ কমেছে। এর মধ্য দিয়ে রপ্তানি আয়ের শীর্ষ তালিকায় পাট আগের অর্থবছরের চতুর্থ স্থান হারিয়ে এখন পঞ্চম স্থানে নেমে এসেছে।

রপ্তানিকারকরা জানান, চাহিদা মাফিক পণ্য পাচ্ছেন না তারা। মানসম্পন্ন পণ্যেরও ঘাটতি রয়েছে। দেশের মিলগুলো উৎপাদনে পিছিয়ে রয়েছে। অপরদিকে কাঁচা পাটের দাম বাড়তি, বাজারও অস্থির। নানা জটিলতায় বাংলাদেশের পাট রপ্তানির বড় বাজার পাশের দেশ ভারতে এখন রপ্তানি কমে গেছে। অপরদিকে আফ্রিকা ও ইউরোপে বিকল্প বাজারগুলোতেও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে দেশি পাটপণ্য। দেশে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এমনটা হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।

কথা হলে বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেজিইএ) সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম পিন্টু বলেন, এ খাতে বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও নানা সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতায় আমরা কেবল পিছিয়ে পড়ছি। বিশ্ববাজারে আমাদের পাটের ব্যাপক সুনাম, অথচ রপ্তানি বাড়ছে না। প্রথম কারণ বিশ্ববাজারে পাট পণ্যের দাম কমেছে; কিন্তু দেশে

কাঁচা পাটের দাম বেড়েছে। পণ্য উৎপাদন খরচও বেড়েছে। তার ওপর কাঁচা পাটের দাম ঘন ঘন ওঠানামা করছে। দেশের মিলগুলো সব সচল না। বিদেশে চাহিদা থাকলেও পণ্য পাচ্ছি না। উৎপাদন বেসরকারি কয়েকটি মিলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সেখানে পণ্যের গুণগতমান সেভাবে বজায় রাখা হচ্ছে না।

বিজেজিইএ সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান আরও বলেন, পাট খাতের উন্নয়নে নীতি সহায়তা রয়েছে; কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন দেখতে পাই না। পলিথিন বন্ধ করে পাটের ব্যাগ ব্যবহারে জোর দেওয়া হলো; কিন্তু পলিথিন বন্ধ হয়নি, পাটের চাহিদা বাড়েনি। উল্টো কাঁচা পাটের দাম বেড়ে গেছে। নীতি সহায়তাগুলোর বাস্তবায়ন হলে কেবল রপ্তানি আয় না, দেশের বাজারও বড় হবে। এ ছাড়া পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্যাংক লেনদেনে রপ্তানিকারকদের নানা জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। এগুলোও দূর করতে হবে।

ইপিবির তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পোশাক, চামড়া, কৃষিসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর রপ্তানি আয় বেড়েছে। সেখানে পাটপণ্য উল্টোপথে হেঁটেছে। পাটে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় হয় পাটের সুতা ও টোয়াইনে। এসব পণ্যেও এবার রপ্তানি ৬ দশমিক ২২ শতাংশ কমেছে। আর কাঁচা পাটের রপ্তানি প্রায় কমেছে ৮ শতাংশ। অন্যান্য পাটপণ্যের রপ্তানি প্রায় ১২ শতাংশ কমেছে। তবে পাটের তৈরি বস্তা ও ব্যাগের রপ্তানি ১৮ দশমিক ৫১ শতাংশ বেড়েছে।

জানা গেছে, বর্তমানে সুদানসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশগুলোতে পাটের ব্যাগ ও বস্তার বিক্রি বেড়েছে। পাশাপাশি তুরস্ক, পাকিস্তান, ইরানসহ আরও কয়েকটি দেশে সুতাসহ অন্যান্য পাটপণ্যের রপ্তানি হচ্ছে। দেশে কাক্সিক্ষত উৎপাদন ও পণ্যের বৈচিত্র্য না থাকায় রপ্তানি আয় কমছে বলে মনে করেন বিজেজিইএর সাবেক চেয়ারম্যান এবং রপ্তানি প্রতিষ্ঠান ‘কম্বাইন্ড ট্রেড লিংক’-এর স্বত্বাধিকারী এস আহমেদ মজুমদার। তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বের দেশগুলো প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব উপকরণ বাধ্যতামূলক করছে। ফলে আফ্রিকার দেশগুলো কফিসহ অন্যান্য পণ্য ইউরোপে রপ্তানি করতে পাটের বস্তা বা ব্যাগে প্যাকেজিং করছে। এতে বস্তার চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু আমরা চাহিদা মাফিক পণ্য দিতে পারছি না। আমাদের মিলগুলোকে সচল করা দরকার, উৎপাদন বাড়ানো দরকার। অপরদিকে ভারতে আমাদের বড় রপ্তানি ছিল। এখন স্থলপথে আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে তারা। এতে রপ্তানি আয় কমেছে।

আহমেদ মজুমদার আরও বলেন, পণ্য রপ্তানি বাড়াতে প্রতিযোগী দেশগুলো বিশ্ববাজারে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়েছে। সে জায়গায় আমরা পিছিয়ে পড়ছি। এতে সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, পাটপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় হওয়া সুতা ও টোয়াইনেও রপ্তানি আয় কমেছে। তারপরও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পাটের সুতা ও টোয়াইনে সবচেয়ে বেশি আয় হয়েছে। এ পণ্যে এবার রপ্তানি আয় এসেছে ৪৬ কোটি ১৮ লাখ ডলার।

রপ্তানি কমে যাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান তাপস প্রামাণিক বলেন, বিদেশে পরে। আগে দেশের ভেতরেই প্লাস্টিক-পলিথিনের সঙ্গে পেড়ে উঠছে না সোনালি আঁশ, প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমাদের আইনে আছে ১৯টি পণ্য বাধ্যতামূলকভাবে পাটে প্যাকেজিং হবে। অথচ আইনের প্রয়োগ নেই। আমাদের পাট আইন আছে। সেটারও বাস্তবায়ন নেই। ফলে কাঁচা পাটের বাজারে ব্যাপারি, ফরিয়া, মজুদদার মিলে দেশি-বিদেশি বিরাট একটা সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। চড়া দামে কিনতে হয়।

তাপস প্রামাণিক বলেন, খরচ কম হওয়ায় বিশ্ববাজারে অনেক ক্রেতা কৃত্রিম ফাইবার ও কটনের দিকে ঝুঁকছে। এতে প্রতিযোগিতা কঠিন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে আমাদের সুতা ও টোয়াইনে সরকারি যে ১০ শতাংশ প্রণোদনা ছিল তা ধাপে ধাপে কমে এখন ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। ফলে আগে যেভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারতাম, এখন সেভাবে পারছি না। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।