শহীদ কাউছারের সৃষ্টিতে শূন্যতা ভোলার চেষ্টা

হাসান মাহমুদ শাকিল, লক্ষ্মীপুর
০১ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
শহীদ কাউছারের সৃষ্টিতে শূন্যতা ভোলার চেষ্টা

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন লক্ষ্মীপুরের মেধাবী ছাত্র কাউছার হোসেন বিজয়। তিনি স্নাতক তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। পড়ালেখার পাশাপাশি গল্প-কবিতাও লিখতেন। তার মা জোসনা আক্তার বলেন, কাউছার মেধাবী ছিল। তার স্বপ্ন ছিল বিসিএস ক্যাডার হবেন। তিনি কবিতা, গল্পও লিখত। তার বাবা স্বপ্ন দেখতেন, তিনি উপন্যাস লিখবে। কিন্তু কারোই স্বপ্নই পূরণ হলো না। এখন ছেলের কবিতা-গল্প পড়ে শূন্যতা ভুলে থাকার চেষ্টা করেন তার বাবা। খাবার টেবিলে তাকে না পেয়ে বুকটা ফেটে যায় তার।

কাউছারের ছোট ভাই আমিন বিপুল বলেন, আম্মু অপেক্ষায় ছিলেন ভাইয়া দুপুরে ভাত খেতে আসবেন। আম্মুও তার সঙ্গে ভাত খাবেন। কিন্তু ভাইয়া আর ফিরে আসলেন না। আম্মুরও তার সঙ্গে আর খাওয়া হলো না। সেদিন থেকে আম্মু আর ঠিকমতো ভাত খেতে পারেন না।

কাউছারের মা জোসনা আক্তার ও বাবা ইসমাইল হোসেন বলেন, আমরা কোনো দান-অনুদান চাই না। শুধু চাই কাউছারসহ সব হত্যার বিচার। বৈষম্যের বিরুদ্ধে কাউছার আন্দোলনে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন। সেই বৈষম্য দূর হবে, তার রক্ত যেন বৃথা না যায়।

কাউছার গত বছরের ৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুর জেলা শহরে যুবলীগ কর্মীদের গুলিতে নিহত হন। তিনি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের উত্তর জয়পুর গ্রামের বাসিন্দা ও লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

কাউছারের মা জোসনা আক্তার জানান, ছেলে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। একজন ছাত্র হিসেবেই কোটা বাতিলের জন্য বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যেতেন। বারবার নিষেধ করলেও তিনি শোনেননি। তিনি বলেন, ‘৪ আগস্ট সকালে কিছু না খেয়েই বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় সে। পথ আগলেও তাকে আটকে রাখতে পারিনি। উল্টো আমার গালে চুমু খেয়ে বলেছিল- ‘মা আমি ফিরে আসব’। পরে দুপুর ২টার দিকে কল দিলে বলেছিল- ‘মা আমি ঝুমুরের সামনে আছি, ভালো আছি’। বিকালে খবর আসে কাউছার গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। হাসপাতালে গিয়ে তাকে শুয়ে থাকতে দেখি আমরা। অনেক ডাকাডাকি করলেও সাড়া দেয়নি। বছর পার হলো, সে আর কথা বলেনি। কারণ সে ঘুমিয়ে আছে মাটির নিচে।’

কাউছারের বাবা ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘ঘটনার দিন দুপুর দেড়টার দিকে ফোনে কাউছারের সঙ্গে শেষ কথা হয়। সে বলেছিল- কোনো সমস্যা নেই, তুমি দোয়া করিও। বিকালে জানতে পারি, গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। মৃত্যুর এক বছর আগে মাদকের ভয়াবহতা নিয়ে রচনা লিখে কাউছার পুরস্কার পেয়েছিল। সে বলত, বাবা একদিন আমি কবি হব, উপন্যাস লিখব। আমার কবিতার বই বের হবে। আমার কবি ছেলেটা আর ফিরে এলো না। তার লেখা কবিতাগুলো পড়ে শূন্যতা ভোলার চেষ্টা করি।’

আমিন বিপুল আরও বলেন, ‘আমি গোপনে আন্দোলনে অংশ নিতাম। আম্মুর বাধা উপেক্ষা করে ৪ আগস্ট আন্দোলনে যাই। কিন্তু হাজিরপাড়া বাজারে যুবলীগ ও মান্দারী বাজারে ছাত্রলীগের হামলার মুখে পড়ি। পরে ভাইয়ার (কাউছার) সঙ্গে ফোনে কথা বললে, সে আমাকে বাড়ি চলে যেতে বলে। দুপুর আড়াইটার দিকেও ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলেছি- বলেছে সে নিরাপদে আছে। কিন্তু তারা ভাইকে বাঁচতে দিল না। আমার এর বিচার চাই।’

প্রসঙ্গত, ৪ আগস্ট সকালে মাদাম ব্রিজ এলাকায় সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক জেলা যুবলীগ সভাপতি একেএম সালাহ উদ্দিন টিপু ও তার ক্যাডারদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। পিছু হটে টিপু মিজ মার্কেটের প্লিংকি প্লাজার ছাদে দলবল নিয়ে অবস্থান নেয় এবং আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি ছোড়ে। থেমে থেমে ৪ ঘণ্টাব্যাপী তার গুলিবর্ষণ চলে। এ ঘটনায় কাউছারসহ চার ছাত্র নিহত হন। এরপর গণপিটুনিতে মারা যান যুবলীগ-ছাত্রলীগের আট নেতাকর্মী-সমর্থক। তারা টিপুর বাসা থেকে পালানোর সময় এ ঘটনা ঘটেছে।