রিজার্ভের ওপর নির্ভর করছে ভোলা-ঢাকা পাইপলাইন

লুৎফর রহমান কাকন
৩০ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
রিজার্ভের ওপর নির্ভর করছে ভোলা-ঢাকা পাইপলাইন

জ¦ালানি বিভাগের ধারণা, দ্বীপজেলা ভোলায় ব্যাপক গ্যাসের রিজার্ভ রয়েছে। এরই মধ্যে ভোলায় অনেক গ্যাস পাওয়া গেছে। অদূর ভবিষতে সেখানে আরও গ্যাসের সন্ধান পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিগত সরকার পরিকল্পনা করেছিল, ভোলা থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে খুলনায় গ্যাস আসবে। খুলনায় কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র সেই গ্যাসে চলবে। বর্তমান সরকার সেটা পরিবর্তন করে ভোলা থেকে ঢাকা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, ভোলা থেকে পাইপলাইনে গ্যাস আনার পরিকল্পনা নির্ভর করছে ভোলার নতুন পাঁচটি গ্যাস কূপের গ্যাস পাওয়া ও রিজার্ভের ওপর। সেখানে বেশি পরিমাণ গ্যাস পেলে তবেই পাইপলাইন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) প্রকৌশলী রেজানুর রহমান বলেন, ভোলায় অনেক গ্যাস আছে। সেটা মূল ভূখ-ে পাইপলাইনে আনতে চায় সরকার। সেখানে আরও পাঁচটি গ্যাস কূপ খনন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেটার ফলাফলের ওপর পাইপলাইন প্রকল্পটির ভবিষৎ নির্ভর করবে। অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হলে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।

সরকারের পরিকল্পনা হলো, পাইপলাইনে গ্যাস আনা হবে ঢাকায়। তারপর ভিন্ন একটি পাইপলাইনের মাধ্যমে নেওয়া হবে খুলনায়। সম্প্রতি সরকার নতুন এই পরিকল্পনা নিয়েছে। এরই মধ্যে ভোলা-বরিশাল পাইপলাইন নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ। বরিশাল-ঢাকা পাইপলাইন স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করবে সরকার। এই পাইপলাইনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের অনুমোদন দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানিয়েছেন।

জ্বালানি ও খনিজসম্পদ সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, ভোলার গ্যাস আগে ঢাকায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ জন্য ভোলা থেকে একটি পাইপলাইন বরিশাল হয়ে ঢাকায় আসবে। পরে বরিশাল-খুলনা পাইপলাইন নিয়ে কাজ হবে। ঢাকায় গ্যাসের চাহিদা বেশি। কারণ এখানে শিল্প-কারখানা অনেক বেশি।

জ¦ালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেছেন, বিভিন্ন সার্ভে রিপোর্ট থেকে জানা যায় ভোলা সত্যিকার অর্থেই গ্যাসের আধার, সেখানে অনেক বেশি কূপ খনন করতে হবে। সেখানে বিশাল পরিমাণ গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সরকারের উচিত দ্রুত পাইপলাইন নির্মাণ করা। ভোলায় শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে ব্যবসায়ীদেরও উৎসাহিত করা উচিত।

জানা গেছে, ২০২৩ সালে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি (জিটিসিএল) ভোলা থেকে বরিশাল পর্যন্ত একটি পাইপলাইন নির্মাণের প্রস্তাব করে। ৯৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ওই পাইপলাইনের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। তবে বরিশাল পর্যন্ত সংযোগ দিয়ে ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা সম্ভব না হওয়ায় প্রকল্পটি সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে বরিশাল থেকে খুলনা পর্যন্ত ১০৯ কিলোমিটার পাইপলাইন করার পরিকল্পনা করা হয়। পুরো প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয় ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ২০২৯ সালের মধ্যে এ প্রকল্প শেষ করার কথা; কিন্তু চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে ওই পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনে জ্বালানি বিভাগ।

উল্লেখ্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস ও সিলেটের বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের পর ভোলাতেই এখন পর্যন্ত বড় গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া গেছে। সেখানে এর মধ্যে যত কূপ খনন করা হয়েছে, সবগুলোতেই গ্যাসের সন্ধান নিশ্চিত করা হয়েছে। ভোলা ইস্ট থেকে ভোলা নর্থের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার, সেখানে গ্যাস পাওয়া গেছে। বিবিয়ানার পর এটা হতে যাচ্ছে সবচেয়ে বড় রিজার্ভ। এরই মধ্যে ভোলায় দুটি গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কৃত হয়েছে। তাতে প্রায় ৮ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস মজুদের আশা করা হচ্ছে।

গ্যাসফিল্ড দুটিতে মোট ৯টি কূপ খনন করা হয়েছে, যা দিয়ে দৈনিক প্রায় ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। ৯টি কূপের মধ্যে ৫টি এখনই গ্যাস উৎপাদনে সক্ষম, যেগুলো থেকে দৈনিক ১৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ সম্ভব। অপর ৪টি কূপের মধ্যে ১টির পাইপলাইন এবং ৩টি কূপের প্রসেস প্ল্যান্ট রেডি হচ্ছে। ভোলায় আরও ১০টি কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছে বাপেক্স। তবে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই সেখানে ৪টি মূল্যায়ন কাম উন্নয়ন কূপ শাহবাজপুর ৫, ৭ এবং ভোলা নর্থ ৩, ৪ এবং একটি অনুসন্ধান কূপ শাতবাজপুর নর্থ ইস্ট-১ খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে সরকার। এগুলোর রিজার্ভের ওপর নির্ভর করেই পাইপলাইনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

ভোলায় গ্যাসের স্থানীয়ভাবে চাহিদা না থাকায় দৈনিক মাত্র ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট উত্তোলন করা হচ্ছে, আবার পাইপলাইন না থাকায় জাতীয় গ্রিডে দেওয়া যাচ্ছে না। বিগত সরকার সিএনজি আকারে ৫ মিলিয়ন ঘনফুট আনার জন্য একটি কোম্পানিকে অনুমোদন দেয়। কোম্পানিটি দৈনিক সর্বোচ্চ ৩ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ দিয়েছে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর এলাকার কয়েকটি কারখানায়।

অন্যদিকে ভোলা থেকে দৈনিক ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এলএনজি আকারে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ নিয়ে ডিপিপি তৈরি করছে পেট্রোবাংলা। ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে সরবরাহ শুরুর পরিকল্পনা নিশ্চিত করেছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ।

এক সময় দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলো থেকে দৈনিক ২ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যেত। এখন ১ হাজার ৮০০ মিলিয়নের নিচে নেমে গেছে। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, দেশের বড় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানার মজুদ ফুরিয়ে আসছে। দেশীয় উৎসের ৫০ শতাংশ জোগান আসছে ওই গ্যাসফিল্ড থেকে। এক সময় ১৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হলেও সেটা এখন এক হাজারের নিচে নেমে গেছে। ২০২৬ সাল নাগাদ গ্যাসক্ষেত্রটির মজুদ শেষ হয়ে যেতে পারে। আশঙ্কা সত্যি হলে রাজধানী ও আশপাশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিতে পারে।