দেড় ডজন ব্যাংকের ঋণের সীমা লঙ্ঘন

জিয়াদুল ইসলাম
২৯ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
দেড় ডজন ব্যাংকের ঋণের সীমা লঙ্ঘন

একটি ব্যাংক তার সংগৃহীত আমানতের কত শতাংশ ঋণ দিতে পারবে, তার সীমা বেঁধে দেওয়া আছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই সীমা লঙ্ঘন করে ঋণ দিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকারি-বেসরকারি প্রায় দেড় ডজন ব্যাংক। এ তালিকায় আছে শরিয়াভিত্তিক অন্তত সাতটি ব্যাংক, যার পাঁচটিই ছিল বিতর্কিত এস আলমের নিয়ন্ত্রণে। এর মধ্যে কোনো কোনো ব্যাংক সংগৃহীত আমানতের শতভাগের বেশি ঋণ দিয়েছে। ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী এই ঋণ কার্যক্রম তারল্য সংকট বাড়ানোর পাশাপাশি আমানতকারীদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বারবার তাগাদা সত্ত্বেও সীমার মধ্যে বিনিয়োগ নামিয়ে আনতে পারছে না তারা। উপরন্তু তালিকায় থাকা বেশ কয়েকটি ব্যাংক চাহিদা অনুযায়ী আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না।

বিদ্যমান নিয়মে, প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো সংগৃহীত আমানতের সর্বোচ্চ ৮৭ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকগুলো সংগৃহীত আমানতের সর্বোচ্চ ৯২ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে পারে। ঋণ ও আমানতের এই অনুপাত এডিআর হিসেবে পরিচিত। সূত্র বলছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে ঋণের নামে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। যেসব ব্যাংকে লুটপাট বেশি হয়েছে, এডিআর সীমা লঙ্ঘনের তালিকায় সেসব ব্যাংকের সংখ্যাই বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ২৯ মে পর্যন্ত হিসাবে সরকারি-বেসরকারি ১৭টি ব্যাংকের ক্ষেত্রে ঋণ ও আমানতের অনুপাতে (এডিআর) সীমা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সাতটি ইসলামি ও ১০টি প্রচলিত ধারার ব্যাংক। এগুলোর মধ্যে আছে জনতা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, এবি ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক (ইসলামি), ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, আইএফআইসি ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এনআরবি, ইউসিবি ও সাউথইস্ট ব্যাংক। এ সময়ে প্রচলিত ধারার একটিসহ মোট সাতটি ব্যাংকের এডিআর ১০০ শতাংশের বেশি রয়েছে। অর্থাৎ, ব্যাংকগুলো সংগৃহীত আমানতের চেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান আমাদের সময়কে বলেন, সম্প্রতি অনেক বেশি আমানত উত্তোলন হয়েছে, যার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর এডিআর বেশি দেখাচ্ছে। যেসব ব্যাংকের এডিআর সীমার বেশি রয়েছে সেগুলোকে দ্রুততম সময়ে তা সমন্বয়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এডিআর সীমা লঙ্ঘন করে ঋণ দিয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক। ব্যাংকটির গত ২৯ মে পর্যন্ত এডিআর ছিল ১১৮.৪৮ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ সীমা লঙ্ঘন বেসরকারি এবি ব্যাংক ৯৭.৯৩ শতাংশ। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক ৯৫.৬৬ শতাংশ, জনতা ব্যাংক ৯০.৬৭ শতাংশ, ইউসিবি ব্যাংক ৮৯.৫৯ শতাংশ, প্রিমিয়ার ব্যাংক ৮৮.৬৬ শতাংশ, সাউথইস্ট ব্যাংক ৮৭.৫৪ শতাংশ, এনআরবি ব্যাংক ৮৭.১২ শতাংশ, আইএফআইসি ব্যাংকের ৮৭.০৫ শতাংশ এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ইসলামী উয়িংয়ের ১২৯.৬৮ শতাংশ এডিআর রয়েছে।

ইসলামি শরিয়াহ পরিচালিত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩৭.৩৬ শতাংশ এডিআর রয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এডিআর সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংকের ১২৬.৬৯ শতাংশ। তৃতীয় সর্বোচ্চ ১১৮.৮৭ শতাংশ এডিআর রয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংকের। এ ছাড়া এক্সিম ব্যাংকের ১২৪.৮৯ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংকের ১১৬.৫৮ শতাংশ, ইসলামী ব্যাংকের ১০৩.২০ শতাংশ ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৯৭.৭৯ শতাংশ এডিআর রয়েছে।

জানা যায়, কোভিড মহামারির আগে ব্যাংক খাতে নির্ধারিত সীমায় বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে টানা পাঁচবার এডিআর সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও অনেক ব্যাংক এটি সমন্বয় করতে পারেনি। পরে কোভিডের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- সীমিত হয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে গতিশীলতা আনা ও ব্যাংক খাতের সার্বিক তারল্য পরিস্থিতির উন্নয়নে ২০২০ সালের এপ্রিলে এডিআর ২ শতাংশ বাড়িয়ে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর জন্য ৮৭ শতাংশ ও ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর জন্য ৯২ শতাংশ নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর আর সেই সীমায় পরিবর্তন আনেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।