পিচ্ছিল রানওয়েতে ঝুঁকি নিয়ে চলছে বিমান

গোলাম সাত্তার রনি
২৯ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
পিচ্ছিল রানওয়েতে ঝুঁকি নিয়ে চলছে বিমান

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের ৮ বিমানবন্দরে নেই রাবার ডিপোজিট অপসারণ মেশিন। আধুনিক প্রযুক্তির বদলে সেকেলে পদ্ধতিতে কোদাল দিয়ে চেঁছে জমে থাকা রাবার অপসারণ করে থাকে কর্তৃপক্ষ। বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণকালে ঘর্ষণের কারণে চাকার টায়ার থেকে রাবার জমা হয় রানওয়েতে। এটাকে রাবার ডিপোজিট বলে। এর ফলে অতিবৃষ্টি বা অতি তাপমাত্রায় রানওয়ে পিচ্ছিল হয়ে যায়, যা বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করে। ঝুঁকি এড়াতে দেশের বিমানবন্দরগুলোর রানওয়ের রাবার অপসারণ করা হলেও তা সঠিক পদ্ধতিতে করা হচ্ছে না। উন্নত বিশ্বের আধুনিক প্রযুক্তির রাবার অপসারণ মেশিন দিয়ে রানওয়ের রাবার অপসারণ করা হয়।

জানা গেছে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বা অভ্যন্তরীণ কোনো বিমানবন্দরেই রানওয়ের রাবার অপসারণ যন্ত্র নেই। ফলে প্রতিদিন যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ ওঠানামার সময় রানওয়ে পিচ্ছিল হয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে সামান্য বৃষ্টিতেই রানওয়ে ভিজে থাকে দীর্ঘ সময়, তার ওপর উড়োজাহাজের চাকার ঘর্ষণে জমে থাকা রাবারের আস্তরণ এ পরিস্থিতিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। রাবার অপসারণ যন্ত্র না থাকার কারণে পিচ্ছিল রানওয়েতেই প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়েই চলছে বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ।

উদ্ভূত এই পরিস্থিতিতে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের রানওয়েতে রাবার জমা অপসারণ সরঞ্জাম (রবার ডিপোজিট রিমুভাল ইকুইপমেন্ট) সরবরাহের জন্য ২০২৩ সালের অক্টোবরে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যানের দপ্তরে চিঠি দিয়েছিলেন শাহজালাল বিমানবন্দরের সাবেক নির্বাহী পরিচালক। কিন্তু প্রায় দুই বছরেও রাবার অপসারণ মেশিন সরবরাহ করতে পারেনি বেবিচক। সম্প্র্রতি শাহাজালাল বিমানবন্দরের জন্য একটি রাবার অপসারণ মেশিন কেনার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হলেও অন্য বিমানবন্দরগুলোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

বেবিচক চেয়ারম্যানের দপ্তরে শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালকের পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উড্ডয়ন-অবতরণের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় রানওয়েতে রাবার ডিপোজিটের পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য প্রচুর পরিমাণ রাবার জমে থাকায় অতিবৃষ্টি বা অতি তাপমাত্রায় রানওয়ে স্লিপারি হয়ে থাকে। কিন্তু এই বিমানবন্দরে রাবার অপসারণের কোনো যন্ত্র নেই। চিঠিতে ফ্লাইট সেফটি কনসালটেন্টদের পরিদর্শন প্রতিবেদনের কথাও উল্লেখ করা হয়, যাতে অ্যারোড্রোম (বিমান চলাচল এলাকা) মেইনটেন্যান্স ম্যানুয়াল অনুযায়ী রাবার অপসারণের তাগাদা দেওয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে নিরাপদ উড্ডয়ন-অবতরণের জন্য আইকাউ স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী রাবার ডিপোজিট রিমুভাল ইকুইপমেন্ট সরবরাহের অনুরোধ জানানো হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেবিচকের এক কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা আইকাওয়ের নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রানওয়ের ঘর্ষণ শক্তি নির্দিষ্ট মাত্রার নিচে নামলে তা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে গণ্য করা হয়। তখনই রাবার অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এই ঘর্ষণ শক্তি পরিমাপের যন্ত্রও খুবই সীমিত, আর রাবার অপসারণ যন্ত্র তো নেই। এমন পরিস্থিতিতে দেশের প্রধান বিমানবন্দর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ অন্যান্য অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরগুলোয় পিচ্ছিল রানওয়ে ঝুঁকি তৈরি করছে। বর্তমানে রানওয়ে পরিষ্কারের জন্য যেটুকু ব্যবস্থা আছে, তা সম্পূর্ণরূপে ম্যানুয়াল বা হাতুড়ি-কোদাল পদ্ধতির। এতে করে কেবল সামান্য অংশে রাবার পরিষ্কার করা সম্ভব হচ্ছে, সেটিও অনেক সময়সাপেক্ষ এবং জনবলের প্রয়োজন। অথচ আধুনিক বিমানবন্দরগুলোতে হাই-প্রেশার ওয়াটার জেট, ভ্যাকুয়াম সিস্টেম এবং অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে মুহূর্তেই পুরো রানওয়ে পরিষ্কার করা হয়।

শাহাজালাল বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তা বলেন, বিমান চলাচল শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে নয়, রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যদি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না হয়, কিংবা নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা যায়, তবে তা শুধু যাত্রীদের ঝুঁকির মধ্যেই ফেলে না, দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মফিদুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী রানওয়ের রাবার অপসারণ একটি বাধ্যতামূলক রক্ষণাবেক্ষণ প্রক্রিয়া। কোদাল দিয়ে রানওয়েতে জমে থাকা রাবার অপসারণের কারণে রানওয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে বিমান দুর্ঘটনার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

সিভিল অ্যাভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক বিদেশে থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এর জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা মুহাম্মাদ কাউছার মাহমুদ আমাদের সময়কে বলেন, তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন শাহজালাল বিমানবন্দরের জন্য একটি রাবার ডিপোজিট অপসারন মেশিন ক্রয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ বিভাগের জিএম কামরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, রানওয়েতে রাবার জমে পিচ্ছিল হয়ে যাওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।