আজও হয়নি ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর নীতিমালা

শাহাজাহান আকন্দ শুভ ও সাজ্জাদ মাহমুদ খান
২৯ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
আজও হয়নি ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর নীতিমালা

ডাণ্ডাবেড়ির অপব্যবহার থামছেই না। দুর্ধর্ষ প্রকৃতির নয়- এমন বন্দিদেরও ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হচ্ছে। কাকে ডা-াবেড়ি পরানো যাবে আর কাকে যাবে না, এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গণহারে ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর ঘটনা ঘটেছে। এমনকী গায়েবি মামলার আসামি হয়ে কারাগারে যাওয়া বিরোধী দলের কয়েকজন নেতাকর্মীকেও বাবা-মায়ের জানাজায় নেওয়া হয় ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে। একের পর এক এ ধরনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালে উচ্চ আদালত ডাণ্ডাবেড়ির অপব্যবহার রোধে কেন নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে না- জানতে চেয়ে রুল দিয়েছিলেন। সেই রুলের সুরাহা হয়নি, নীতিমালাও হয়নি। ফলে ডা-াবেড়ির অপব্যবহার থামেনি এখনও। 

এদিকে হাতকড়া ও ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আসামিকে আদালতে উপস্থাপন করা যাবে না বলে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। সেই নির্দেশও অনুসরণ করছে না সংশ্লিষ্টরা। যে কারণে হাতকড়া ও ডাণ্ডাবেড়ি পরানো অবস্থায় আসামিকে আদালতে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ঢাকার নিম্ন আদালতে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে জানা যায়।

জানা গেছে, গতকাল ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে হাজির করা হয় মো. আলম নামের এক আসামিকে। শরীয়তপুর জেলার পালংয়ের নুরুল ইসলামের ছেলে আলম মিরপুরের লেগুনাচালক মো. হাসান হত্যা মামলার আসামি। ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট মিরপুরের ১২ নম্বর সেকশনের ডি ব্লকের মায়ের দোয়া ফার্নিচারের দোকানের সামনে হাসানকে হত্যা করা হয়। আলমসহ ওই মামলার আসামি পাঁচজন। গ্রেপ্তারের পর প্রায় ১০ বছর আলম কারাগারে আছেন। এই হত্যা মামলা ছাড়া তার বিরুদ্ধে আর কোনো মামলা নেই। তাকেও ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। 

আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বিচারাধীন মামলায় এমন একজন আসামিকে এভাবে ডাণ্ডাবেড়ি পরানো বেআইনি ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এটি নির্যাতন। কেবলমাত্র ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’ বা ‘পালানোর উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা’ বন্দিদের ক্ষেত্রেই ডাণ্ডাবেড়ি ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে। বাংলাদেশ জেল কোড অনুযায়ী, বিশেষ নিরাপত্তার প্রয়োজনে এবং বিচারাধীন বা দ-প্রাপ্ত বিপজ্জনক বন্দিদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ডা-াবেড়ি ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে। তবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ আছে, প্রতিটি ব্যবহারের বিষয়ে লিখিত রেকর্ড রাখা বাধ্যতামূলক।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, ডাণ্ডাবেড়ি শুধু শারীরিক নিপীড়নের ব্যাপার নয়, এতে একজন মানুষের মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের অধিকারও ক্ষুণ্ন হয়। যেভাবে এর অপব্যবহার হচ্ছে, তা উদ্বেগজনক।

একটি গায়েবি মামলায় ২০২২ সালে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আলী আজম। ওই বছর ১৮ ডিসেম্বর আলী আজমের মা মারা যান। শেষবার মাকে দেখতে ও মায়ের জানাজায় অংশ নিতে ২০ ডিসেম্বর তিন ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি পান তিনি। তাকে হাতকড়া ও ডা-াবেড়ি পরিয়ে মায়ের জানাজায় হাজির করা হয়। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির 

আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ২০২৩ সালে প্যারোলে মুক্তি পাওয়া বন্দিদের ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর বৈধতা নিয়ে রিট করেছিলেন। পরে উচ্চ আদালত ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়নে কেন কমিটি গঠন করা হবে না- জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। কিন্তু রুল নিষ্পত্তি না হওয়ায় নীতিমালাও হয়নি।

গত রাতে ব্যারিস্টার কায়সার কামাল আমাদের সময়কে বলেন, সেই রুলটা ইস্যু হয়ে আছে। এরপর আর অগ্রগতি নেই। এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে রুলটা শুনানি করলেই হতো। তিনি বলেন, সরকারের পরিবর্তন হয়েছে, পলিসির পরিবর্তন হয়নি। এটাই তার জলন্ত উদাহরণ। 

২০১৭ সালের ১৩ মার্চ উচ্চ আদালত স্বপ্রণোদিত এক রুলের আদেশে বলেন, কোনো আসামিকে আদালতে হাজির করার সময় যেন সে মনে করে, সে কারাগারে নয়, আদালতের অধীন। তাই দেশের সব কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হলো- তারা যেন কাউকে ডাণ্ডাবেড়ি, হাতকড়া বা কোমরে দড়ি বেঁধে কোনো আদালতে না আনেন। তবে নিরাপত্তার প্রয়োজনে ফেটার বা হাতকড়া দিয়ে আদালতের প্রাঙ্গণে আনা যেতে পারে, তবে আদালতের কক্ষে প্রবেশের আগে তা খুলে ফেলতে হবে। তবে কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে যদি কোনো গুরুতর অপরাধের আসামিকে ফেটার বা হাতকড়া পরিয়ে আদালতে হাজির করতে হয়, তাহলে আদালতের অনুমতি নিতে হবে।

ঢাকার নিম্ন আদালতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, উচ্চ আদালতের সেই আদেশ যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না। ডা-াবেড়ি পরিয়েই আসামিদের আদালতে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আবার নীতিমালা না হওয়ায় পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের মতো অনেক ক্ষেত্রেই অনেককে ডা-াবেড়ি পরানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা জেলকোড এবং আদালতের নির্দেশনা মানছেন না।   

কারা অধিদপ্তরের সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন) মোঃ জান্নাত-উল ফরহাদ আমাদের সময়কে বলেন, কোনো বন্দিকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করতে কারা কর্তৃপক্ষ কখনও ডাণ্ডাবেড়ি পরায় না। পুলিশের রিকুইজিশনের পরিপ্রেক্ষিতেই জেল কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট বন্দির পায়ে ডা-াবেড়ি পরিয়ে থাকে।

বাংলাদেশ জেলকোডে কেবলমাত্র দুর্ধর্ষ বন্দিদের নিরাপদে আদালতে পাঠানোর সময় পায়ে ডা-াবেড়ি পরানোর কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া দুর্ধর্ষ কিংবা ঘৃণ্য অপরাধী কে বা কারা, সেটি চিহ্নিত করা আদালতে কর্মরত পুলিশ পরিদর্শকের দায়িত্ব। তিনি আসামির অতীতের অপরাধের ইতিহাস জেনে দুর্ধর্ষ কি না, তা চিহ্নিত করবেন। কোর্টের পুলিশ পরিদর্শক এমন আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আগে সংশ্লিষ্ট জেলারকে লিখিতভাবে জানাবেন। পুলিশের লিখিত চিঠি পাওয়ার পর সব ধরনের তথ্য বিশ্লেষণ করে কারা কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে বন্দি দুর্ধর্ষ, যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত এবং উগ্র বা ভয়ংকর প্রকৃতির, পালানোর চেষ্টা করতে পারে; তবেই কারারুদ্ধ অবস্থায়ও তার পায়ে ডা-াবেড়ি পরাতে পারবেন। কিন্তু বিগত বছরগুলোয় এ ব্যবস্থাও অনুসরণ করা হয়নি। ২০২২ সালে ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর গণহারে ডা-াবেড়ি পরানো ওই সময় বেড়ে যায়। সম্প্রতি চট্টগ্রাম আদালত থেকে কারাগারে ফেরার পথে আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের একাধিক নেতাকে ডা-াবেড়ি পরিয়ে আনা-নেওয়া করতে দেখা যায়। সামাজিক মাধ্যমে এ ধরনের ছবিও ভাইরাল হয়।

এদিকে চলমান বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের মধ্যে দুর্ধর্ষ প্রকৃতির আসামিও রয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পালিয়ে যেতে পারে কিংবা কারাগারের ভেতর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেÑ এমন তথ্য রয়েছে জেল কর্তৃপক্ষের কাছে। এ ছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে বিশেষ অভিযানে এ ধরনের আসামি বাড়তে পারে কারাগারে। এ প্রেক্ষাপটে কোনো কোনো কারা কর্তৃপক্ষ ডা-াবেড়ির মজুদ বাড়াচ্ছে। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে ৮০০ ডা-াবেড়ির একটি চালান সরবরাহ নিয়েছে। 

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একজন আইন বিশেষজ্ঞ আমাদের সময়কে বলেন, একটি কারাগারে ৮০০ ডা-াবেড়ি কেনা অপ্রয়োজনীয়। কোনো কারাগারে ৮০০ দুর্ধর্ষ ব্যক্তিকে ডা-াবেড়ি পরানোর বিষয়টি অস্বাভাবিক ঘটনা। তিনি বলেন, এই ডা-াবেড়ি ক্রয়ের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগও থাকতে পারে।  

নতুন করে এত ডা-াবেড়ি সংগ্রহের কারণ জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. ইকবাল হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ডা-াবেড়ির ব্যবহার কখনও বন্ধ হয়নি।কে আসামিদের আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে ডাণ্ডাবেড়ির ব্যবহার হয়। আবার এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে কয়েদি ও হাজতিদের আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রেও ডাণ্ডাবেড়ির ব্যবহার হয়ে থাকে।