ট্রমায় ক্যাম্পাসবিমুখ শিক্ষার্থীরা, ক্লাস শুরু নিয়ে দ্বিধায় কর্তৃপক্ষ
উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর কেটে গেছে এক সপ্তাহ। কিন্তু ভয়াবহ সেই ঘটনার রেশ কাটেনি। ক্যাম্পাসে ফেরার কথা শুনলেই আঁতকে উঠছে শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যেই ট্রমায় ভোগা শিক্ষার্থীদের মানসিক পুনর্বাসনে চালু করা হয়েছে কাউন্সেলিং সেন্টার। প্রতিদিন সেখানে ভিড় করছেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। তবুও সেদিনের বিকট শব্দ, পুড়ে যাওয়া সহপাঠী, ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া শ্রেণিকক্ষ- সবই যেন এখনও তাদের চোখের সামনে ভাসছে। এদিকে, দুর্ঘটনাস্থল ঘিরে এখনও হাজারো উৎসুক মানুষের ভিড় নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এমন পরিস্থিতিতে একাডেমিক কার্যক্রম, বিশেষ করে ক্লাস শুরু করা নিয়ে দ্বিধায় রয়েছে স্কুল প্রশাসন।
সেদিনের দুর্ঘটনা নিয়ে কথা হয় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সাহিদ সাবিরের সঙ্গে। সে জানায়, বিধ্বস্ত ভবনেই ছিল তার শ্রেণিকক্ষ। দুর্ঘটনার দিন কোচিং ক্লাসে ব্যাগ রেখে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিল ভবনের অপরপ্রান্তে। তখনই বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো ভবন। আগুন-ধোঁয়ায় ঢেকে যায় চারদিক। এখনও বিমানের শব্দ শুনলেই গা শিউরে ওঠে। স্কুলে যাওয়ার কথা শুনলে ভয়ে ঘুমাতে পারে না। তার বাবা রবিউল ইসলাম বলেন, মাত্র এক মাস আগে ওর মা মারা গেছে। সেই শোক না কাটতেই এই দুর্ঘটনা। এখন সে কোনোভাবেই এই ক্যাম্পাসে ফিরতে রাজি হচ্ছে না। ভাবছি ওকে অন্য শাখায় নিয়ে যাব।
কাউন্সেলিং সেন্টারে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে : ট্রমা কাটিয়ে উঠতে মাইলস্টোনের পক্ষ থেকে চালু করা হয়েছে তিনটি কাউন্সেলিং সেন্টার। সেখানে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের দুজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং একজন অভ্যন্তরীণ চিকিৎসক কাজ করছেন। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত চলে সেবা। সেন্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডা. শাহপারনেওয়াজ ইশা আমাদের সময়কে বলেন, শিক্ষার্থীরা আতঙ্ক, দুঃস্বপ্ন, ঘুম না হওয়া, শব্দের ভয়ে কেঁপে ওঠা, কান্না এবং শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছে। প্রথম দুই দিন কম এলেও এখন সেবা নেওয়ার শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। তিনি বলেন, ওই বিমান দুর্ঘটনা শিক্ষার্থীদের মানসিক জগতে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। তারা ফিরে যেতে ভয় পায় ক্লাসে, চোখে ভাসে সহপাঠীদের মৃত্যু। এমন এক সংকটময় পরিস্থিতিতে আমরা চেষ্টা করছি শিক্ষার্থীদের মনে আবার বিশ্বাস ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে।
একজন অভিভাবক জানান, তার ছেলে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে মাঠে দাঁড়িয়ে ছিল। একেবারে ওর মাথার ওপর দিয়ে গিয়েছিল বিমানটা। এখনও রাতে ঘুমাতে পারে না। খাবারও কম খাচ্ছে। কাউন্সেলিংয়ের চিকিৎসক প্রায় ৪০ মিনিট ধরে ওর সঙ্গে কথা বলেছেন। এর পর থেকে কিছুটা স্বস্তি অনুভব করেছে।
জনতার ভিড়ে ক্যাম্পাস বিপর্যস্ত : শুধু অভ্যন্তরীণ সংকট নয়, এখনও বহিরাগত উৎসুক জনতার ভিড়ে ক্যাম্পাস বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রবেশপথ খোলা থাকায় প্রতিদিন ভোর থেকে হাজারো মানুষ প্রবেশ করছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ভবন, পাইলটের পড়ার স্থান- সব ঘিরে রয়েছে জটলা। ক্যাম্পাসের সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা শফিকুল ইসলাম জানান, ফজরের নামাজের পর থেকেই ভিড় শুরু হয়। প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার মানুষ প্রবেশ করছে। অনেকে শিক্ষার্থীদের টয়লেটে পর্যন্ত ঢুকে পড়ছে। কেউ কেউ বলছে, ‘ভেতরে লাশ গুম করা হয়েছে’। এমন গুজবে ক্যাম্পাসের পরিবেশ আরও খারাপ হচ্ছে।
ক্লাস শুরুর সিদ্ধান্তে অনিশ্চয়তা : এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি নিয়েও বিপাকে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপাল (প্রশাসন) মোহাম্মদ মাসুদ আলম আমাদের সময়কে বলেন, রবিবার (গতকাল) থেকে নবম ও একাদশ শ্রেণির ক্লাস চালুর ঘোষণা দিয়েছিলাম। কিন্তু উৎসুক জনতার চাপ ও গুজবের কারণে সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছি। গেট বন্ধ করে ক্লাস নিলে গুজব ছড়ানোর আশঙ্কা আছে। ‘ভেতরে লাশ লুকানো হচ্ছে’- এমন কথাও শুনছি। আপাতত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
অভিভাবকদের প্রত্যাশা : এদিকে, অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা বুঝে ক্লাস শুরুর আগে আরও প্রস্তুতি চান। অভিভাবক আমিরুল ইসলাম বলেন, এই বয়সে শিশুরা এমন ট্রমা নিয়ে স্কুলে ফিরলে তা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। তাই কাউন্সেলিং কার্যক্রম জোরদার করে, ধাপে ধাপে শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা চাই সন্তানরা আবার ক্লাসে ফিরে আসুক, কিন্তু জোর করে নয়। মন থেকে প্রস্তুত হলে, তবেই যেন ফেরানো হয়।
আরও দুজনকে ছাড়পত্র, আইসিইউতে সংকটাপন্ন ৪ : গতকাল বেলা ৩টার দিকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এক সংবাদ সম্মেলনে ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ আরও দুজনকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। তারা হলেন- কাজী আমজাদ সাইদ (২০) ও সবুজা (৪০)। আমজাদ উদ্ধারকারী হিসেবে কাজ করছিলেন আর সবুজা স্কুলের কর্মচারী। এ নিয়ে শনি ও রবিবার চারজন হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছে। এখনও সংকটাপন্ন অবস্থায় আইসিইউতে রয়েছে চারজন।
ডা. নাসির জানান, বর্তমানে বার্ন ইনস্টিটিউটে ৩৪ রোগী ভর্তি রয়েছে, যাদের ২৮ জনই শিশু। এদের মধ্যে সংকটাপন্ন চারজনকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। এদের চাইতে একটু কম গুরুতর অবস্থায় রয়েছে ৯ জন। বাকিরা অন্যান্য ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছে। আপাতত মোট ভর্তি থাকা ৩৪ রোগীর মধ্যে শরীরে ৩০ শতাংশের বেশি দগ্ধ হয়েছে এমন রোগী আছে ৬ জন।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
আলামত সংগ্রহে বিমানবাহিনী : মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হায়দার আলী ভবনের সামনে থেকে বিধ্বস্ত হওয়া যুদ্ধবিমানের আলামত সংগ্রহ করেছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সদস্যরা। গতকাল তারা ক্ষতিগ্রস্ত ভবন, শ্রেণিকক্ষ ও আশপাশের বিভিন্ন স্থান থেকে আলামত সংগ্রহ করে ট্রাকে ভরে নিয়ে যান তারা।
মৃত্যুর কাছে হার মানা মাসুমার দাফন : বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর কাছে হার মানতে হয়েছে মাইলস্টোন স্কুলের আয়া মাসুমাকে। দগ্ধ অবস্থায় পাঁচ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর গত শনিবার সকালে ঢাকা মেডিক্যালের জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে তার মৃত্যু হয়। গতকাল রবিবার সকাল সাড়ে ৯টায় জানাজা শেষে পারিবারিক গোরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
আমাদের ভোলা প্রতিনিধি জানান, শনিবার ভোর রাতে মাসুমার মরদেহ পৌঁছায় তার গ্রামের বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডে। স্বজন, প্রতিবেশী ও গ্রামবাসীরা ভিড় করেন তাকে শেষবার একনজর দেখতে। নিহত মাসুমা মাইলস্টোন স্কুলে আয়ার কাজ করতেন। স্বামী মো. সেলিম ঢাকায় একটি বায়িং হাউসে ড্রাইভার হিসেবে কাজ করেন। মাসুমা তার স্বামী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে রাজধানীর তুরাগ নয়ানগর শুক্রভাঙ্গা এলাকায় বসবাস করতেন। ঘটনার দিন মাসুমা স্কুলে কর্মরত ছিলেন। বিমান দুর্ঘটনায় তার শরীরের ৯০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল।
অন্যদিকে, একই দিনে সকালে ৪০ শতাংশ দগ্ধ নিয়ে ভর্তি সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী জারিফও মারা গেছে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ জনে। দুর্ঘটনায় আহতদের মধ্যে রাজধানীর সাতটি হাসপাতালে এখনও প্রায় অর্ধশতাধিক ব্যক্তি চিকিৎসাধীন রয়েছেন।