ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতিতে এক ধাপ অগ্রগতি
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় প্রতিদিন বাড়ছে অনাহারে শিশু মৃত্যুর ঘটনা। জাতিসংঘ জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল গাজায় হামলা শুরু করে। তারপর থেকে প্রতি তিনজন গাজাবাসীর একজন না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে এখন পর্যন্ত মারা গেছে ১২২ জন। এই পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি নতুনভাবে জোরালো হয়েছে। বিশেষ করে, ফ্রান্স ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেবে- এমন বিবৃতি দেওয়ার পর বিষয়টি আরও গুরুত্ব পেয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। এমনকি ইসরায়েলের মিত্র অনেক দেশও এ নিয়ে আলোচনা করছে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রন এক্সে (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে জানান, আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে তার দেশ। এই ঘোষণায় চটেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি বলেছেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর ফ্রান্সের এমন সিদ্ধান্ত ‘সন্ত্রাসকে পুরস্কৃত’ করছে। যুক্তরাষ্ট্রও ফ্রান্সের ঘোষণায় অসন্তুষ্ট। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও একে ‘বেপরোয়া সিদ্ধান্ত’ বলেছেন এবং এ ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তবে ইউরোপে এখন ফিলিস্তিন স্বীকৃতির বিষয়টি আরও গুরুত্ব পাচ্ছে।
ব্রিটেনের সংসদে ২২১ এমপি একযোগে প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারকে চিঠি দিয়েছেন। তারা চান, যুক্তরাজ্যও ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিক। এই এমপিদের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির। তাদের মতে, যুক্তরাজ্যের স্বীকৃতি বিশ্ববাসীর কাছে একটি শক্তিশালী বার্তা হবে এবং দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে। তারা আশা করছেন, সরকার ইতিবাচক উদ্যোগ নেবে। আগামী সপ্তাহে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সম্মেলনে এ বিষয়ে একটি রূপরেখা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
যুক্তরাজ্য দীর্ঘদিন থেকেই ইসরায়েলের পাশাপাশি সহাবস্থানের ভিত্তিতে একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নীতি সমর্থন করে এসেছে। তবে এখনও ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার জানিয়েছেন, তিনি এখনই সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন না। তিনি বলছেন, এটি একটি বড় শান্তি পরিকল্পনার অংশ হওয়া উচিত। তিনি জার্মানির চ্যান্সেলর ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তিনি ও তার মিত্ররা এ অঞ্চলে শান্তি আনার পথ খুঁজছেন বলে জানান স্টারমার।
আরও পড়ুন:
২৫ জিম্মিকে মুক্তি দিল হামাস
এদিকে রাশিয়া বলেছে, তারা ফিলিস্তিন স্বীকৃতির পক্ষে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানান, রাশিয়া সবসময় দুই রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানকে সমর্থন করেছে। তার মতে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে এই সংকটের সমাধান সম্ভব। ১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিনের নেতা ইয়াসির আরাফাত স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ওই বছরই মস্কো ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়।
তবে ইউরোপের সব দেশ এ ব্যাপারে একমত নয়। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি বলেন, আগে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন হোক, তারপর স্বীকৃতি। তার দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত শুক্রবার বলেন, ফিলিস্তিন যদি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়, তখনই ফিলিস্তিনকেও স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে। জার্মানিও বলেছে, এখনই স্বীকৃতি নয়। তাদের মতে, আগে দুই রাষ্ট্র সমাধানের পথে বাস্তব অগ্রগতি দেখতে চায় তারা।
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য দেশের মধ্যে অন্তত ১৪২টি ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে তালিকাটি পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়। চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি, মাল্টা ও পাপুয়া নিউগিনি ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়নি। আবার মেক্সিকোর স্বীকৃতি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, যদিও দেশটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে দীর্ঘদিন। ভ্যাটিকান সিটি জাতিসংঘ সদস্য নয়, তবুও অনেক সময় তালিকায় যুক্ত হয়। ২০২৩ সালে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর আয়ারল্যান্ড, স্পেন, স্লোভেনিয়া, নরওয়ে ও আর্মেনিয়াসহ ১০টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর মধ্যে ৪টি ক্যারিবীয় দেশও রয়েছে।
গাজায় মানবিক সংকট নিয়েও চাপ বাড়ছে। জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য ইসরায়েলের ওপর চাপ দিচ্ছে। তারা চায়, ত্রাণ সরবরাহে বাধা তুলে নেওয়া হোক এবং যুদ্ধ বন্ধ হোক। জাতিসংঘের খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, গাজায় প্রতি তিনজনের একজন না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। পুষ্টিহীনতা ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। ৯০ হাজার নারী ও শিশুর জরুরি চিকিৎসা দরকার। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত অপুষ্টি ও ক্ষুধায় ১২২ জন মারা গেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে। এখানে নেই করুণা, নেই সত্য, নেই মানবতা।’
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ইসরায়েলে ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন এবং ২৫১ জন জিম্মি হন। এরপরই ইসরায়েল গাজায় আগ্রাসন শুরু করে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।