কোমলমতিদের মানসিক পুনর্বাসনই বড় চ্যালেঞ্জ

এম এইচ রবিন
২৪ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
কোমলমতিদের মানসিক পুনর্বাসনই বড় চ্যালেঞ্জ

‘আমার ছোট ভাইয়ের মনে রাজ্যের ভয় ঢুকে গেছে। মুখে শুধু একটাই কথা- আবার যদি আকাশ থেকে কিছু পড়ে’- এক তরুণী শিক্ষার্থী ভীষণ উদ্বেগের সঙ্গে বলছিলেন কথাগুলো। তার ছোট ভাই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ে। এভাবেই সেই ভাইয়ের মানসিক অবস্থার বর্ণনা দিচ্ছিলেন তরুণী। এ দশা শুধু ওই খুদে শিক্ষার্থীরই নয়, প্রতিষ্ঠানটিতে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণহানির মর্মান্তিক ঘটনা প্রায় সব শিক্ষার্থীর মানসপটেই ভীষণ প্রভাব ফেলেছে।

যে ক্যাম্পাস প্রতিদিন সকালে মুখর হতো শত শত শিক্ষার্থীর কলকাকলিতে, সেই প্রাঙ্গণে এখন সুনসান নীরবতা; ছেয়ে আছে অজানা আতঙ্ক। শোক কাটিয়ে আগামী রবিবার থেকে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করবে কর্তৃপক্ষ। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি যুদ্ধবিমান শুধু একটি ভবন ভাঙেনি, ভেঙে দিয়েছে শত শত শিশুর আত্মবিশ্বাস ও নিরাপত্তাবোধ। সেই ক্ষত সারাতে প্রয়োজন সহানুভূতি, সময় ও প্রস্তুতি। এখনই যদি যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তবে এ দুর্ঘটনা শুধু দুঃসহ স্মৃতি হয়েই থাকবে না, হয়ে উঠবে স্থায়ী মানসিক সংকটের উৎস।

দুর্ঘটনার তৃতীয় দিন গতকাল বুধবারও ক্যাম্পাসের বাইরে সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে উৎসুক মানুষের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেকেই এসেছেন দূর-দূরান্ত থেকে, একঝলক দেখার জন্য। কেউ ছবি তুলছেন, কেউ বা ভিডিও করছেন, কেউ আবার চুপচাপ দাঁড়িয়ে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কাউকে দেখা গেছে হতাহতদের জন্য প্রার্থনা করতে।

নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা পঞ্চাশোর্ধ্ব আবদুল হামিদ বলেন, টিভিতে দেখে মনে হলো দুঃস্বপ্ন। কিন্তু এখানে এসে বুঝলাম, এটা কতটা ভয়ংকর ছিল। ছোট ছোট শিশুদের নিরাপদতম স্থানে যদি এমনটা হয়, তাহলে আমরা আর কোথায় নিরাপদ?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্কুলের আশপাশের এক বাসিন্দা বললেন, ‘বিমান কত নিচে দিয়ে উড়ছিল! ভয় লেগেছিল আগেও। এখন মনে হচ্ছে, এই এলাকা তো রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ!’

শিশুদের আচরণে ইতোমধ্যেই দেখা যাচ্ছে নানা পরিবর্তন। শামীমা নাসরিন নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘আমার মেয়ে এখন একা ঘরে থাকতে চায় না। ঘুমাতে গেলে বলে- মা, আবার কিছু পড়বে না তো? আমি নিজেই বুঝতে পারছি না, কীভাবে ওকে সান্ত¡না দেব।‘ তিনি এ-ও বলেন, ‘আমরা অভিভাবকেরাও প্রস্তুত না। আমাদেরও কাউন্সেলিং দরকার এ পরিস্থিতি সামলে উঠতে।’

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে শারীরিকভাবে আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা চলছে বিভিন্ন হাসপাতালে। তবে সবচেয়ে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত যেটি, সেটি মানসিক। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুরা স্কুলকে তাদের ‘দ্বিতীয় বাড়ি’ হিসেবে দেখে। সেই আশ্রয়ে যদি ভয় ও আতঙ্ক ঢুকে পড়ে, তাহলে শিশুর মানসিক বিকাশে তা মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

এ বিষয়ে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের ফেলো ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. ওবায়দুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘এটি একটি ক্লাসিক ট্রমা। শিশুদের মধ্যে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে- ঘুমের সমস্যা, আতঙ্ক, নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাওয়া, স্কুলভীতি, আচরণগত সমস্যা- সবই সম্ভব। এমনকি যারা মিডিয়ায় শুধু ভিডিও দেখেছে, ওরাও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে।’ তার পরামর্শ, ‘অভিভাবকদের উচিত শিশুর অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, ভয়কে অস্বীকার না করা এবং তাদের পাশে থেকে ভালোবাসা ও ধৈর্যের মাধ্যমে সাহস জোগানো।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাইকিয়াট্রি ফেলো ডা. শহিদুল্লাহ শিশির বলেন, ‘শিশুরা বড়দের ভাষায় নয়, অনুভবে কথা বলে। তাদের আতঙ্ককে ‘দূর করো’ বলা যাবে না, বরং বলা উচিত- তোমার ভয় আমি বুঝতে পারছি, আমি আছি পাশে। শিশুর মন জয় করতে হলে শুনতে হবে তাদের কথা।’ তিনি আরও বলেন, ‘সৃজনশীলতা শিশুদের জন্য এক ধরনের মানসিক মুক্তির পথ। ছবি আঁকা, গল্প লেখা, কবিতা পাঠ- এসবের মধ্য দিয়ে শিশুরা নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে, যা ট্রমা কাটিয়ে ওঠার জন্য অত্যন্ত কার্যকর।

কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা আগামী রবিবার একাডেমিক কার্যক্রম চালু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের মানসিক পুনর্বাসনে। প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ বুলবুল আমাদের সময়কে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোই এখন আমাদের প্রধান অঙ্গীকার। পড়াশোনার ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব, কিন্তু মানসিক ক্ষতিপূরণ না হলে এর প্রভাব পড়বে জীবনব্যাপী। তিনি জানান, স্কুল খোলার পর মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে নিয়মিত কাউন্সেলিং সেশন, একক ও গ্রুপ থেরাপি এবং অভিভাবক ও শিক্ষকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মশালা চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।