ইতস্তত পড়ে থাকা জুতো ব্যাগ খাতায় না বলা কত গল্প

এম এইচ রবিন
২৩ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ইতস্তত পড়ে থাকা জুতো ব্যাগ খাতায় না বলা কত গল্প

উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ চত্বর। ইতস্তত পড়ে আছে পোড়া খাতা, ছেঁড়া ব্যাগ, পুড়ে যাওয়া টিফিন বক্স, ছোট ছোট জুতোসহ আরও কত কী! প্রতিটি বস্তুই না বলা কত কত গল্প; ভয়াবহ এক বাস্তবতার নীরব সাক্ষী। গতকাল সরেজমিনে হৃদয়স্পর্শী এমন দৃশ্য দেখা গেছে।

সন্তান স্কুলে যাবে তাই হয়তো সকাল সকাল উঠে মা টিফিন তৈরি করে দিয়েছিলেন বক্সে ভরে, সন্তান যেন ক্ষুধায় কষ্ট না পায়। কিন্তু সেই খাবার আর মুখে তোলা হয়নি সন্তানের। ¯েœহ-ভালোবাসা মাখানো সেই খাবার মর্মান্তিক এক গল্পের জন্ম দিয়ে পড়ে আছে পোড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপে। বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ধ্বংসস্তূপ সরাতে গিয়ে উদ্ধারকারীরা দেখতে পান ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জুতা, আধপোড়া বই-খাতা, পানির বোতল, ব্যাগ ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যাগগুলো দেখে মনে হয় যেন স্বপ্নময় একেকটি জীবন, সমূলে ঝরে গেছে অঙ্কুরেই। এগুলো আর কখনও কাঁধে ঝুলবে না। পাতায় পাতায় যেসব লেখা ছিল, সেগুলো স্রেফ ছাই। পড়ার টেবিল ছেড়ে যাওয়া সেই শিশুরা আর কখনও ফিরবে না ওদের রঙিন স্বপ্ন আর কল্পনার রাজ্যে।

নিখোঁজ এক মায়ের জন্য অবোধ সন্তানের অপেক্ষা

তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী আফসান ওহি তখনও জানে না, তার মা আফসানা আক্তার প্রিয়া আর কখনও বাসায় ফিরবেন না। বিমান বিধ্বস্তের ঠিক আগমুহূর্তে ছেলের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে তার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও তার কোনো খোঁজ মেলেনি।

ওহি জিজ্ঞেস করে, ‘মা কোথায়?’ মায়ের যে কোনো খোঁজই মেলেনি, সেটি বোঝাবে কে এই একরত্তি শিশুটিকে? তাই ওহির অপেক্ষাও শেষ হয় না। ওর চাচা বলেন, ‘সব জায়গায় খুঁজেছি। হাসপাতালে, মর্গেÑ কোথাও ভাবির খোঁজ নেই। কিন্তু ওহি কিছুতেই মানতে পারছে না; বারবার মাকে খোঁজে। খেতে বসে, ঘুমাতে যাওয়ার আগে... সব সময়।’

খাতা বলছে রাইসা মনির গল্প

তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী রাইসা মনির লাশের সন্ধান পাওয়া গেছে ঢাকার সিএমএইচে। এর আগে, শিশুটির পরিবার হন্যে হয়ে ছুটে বেড়িয়েছে হাসপাতালে আর মর্গে। একটাই আশা, মেয়েটার একটা জামা কিংবা বোতল যদি পাওয়া যায়! শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেছেও। শুধু ছেঁড়া ব্যাগ আর কচি হাতে নিজ নাম লেখা ওর খাতা। সেই খাতাই বলে দিচ্ছে রাইসা মনির গল্প।

মাইলস্টোনের ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর বেরিয়ে এসেছে আরও কিছু রূঢ় সত্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ভয়াবহ গাফিলতির চিত্র। শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ডে নেই রক্তের গ্রুপ, নেই অভিভাবকের নাম বা যোগাযোগ নম্বর। হাসপাতালগুলোতে অভিভাবকরা সন্তান শনাক্ত করতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছেন। ভাইস প্রিন্সিপাল স্বীকার করেছেনÑ এটা তাদের জন্যও শিক্ষণীয়। কিন্তু এ শিক্ষা এলো এত বড় হৃদয়চেরা বেদনা আর শূন্যতার বিনিময়ে!

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি শুধু একটি বিমান দুর্ঘটনাই নয়, আমাদের রাষ্ট্রীয় উদাসীনতারও প্রতিচ্ছবি। যেখানে উন্নয়নের গল্পের আড়ালে চাপা পড়ে যায় মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, শিশুদের ভবিষ্যৎ। মাইলস্টোনের পোড়া ভবনের পাশ দিয়ে যেতে ভেসে আসছে পোড়া খাতার গন্ধ; সেই গন্ধে মিশে আছে অসীম শোক আর অশ্রুর আবহ।

এই শোক, এই অশ্রুপাত শুধু রাইসার প্রিয়জনের নয়; মায়ের সন্ধানে শুধু ওহিরই নয়Ñ আমাদের সবার। এ কান্না একটি রাষ্ট্রের, যে রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারেনি মায়ের রান্না করা িন তার সন্তানের মুখে তুলে দেওয়ার।