জনপ্রতিনিধিহীন স্থানীয় সরকার

নাগরিকসেবা ব্যাহত

শাহজাহান মোল্লা
২২ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
জনপ্রতিনিধিহীন স্থানীয় সরকার

জন্ম ও মৃত্যুসনদ, বৈবাহিক সনদ, জাতীয়তা, ওয়ারিশ সনদ, ভূমি ব্যবহার সনদ, গ্রামীণ রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, নিরাপদ পানি সরবরাহসহ অত্যাবশকীয় সেবা বাস্তবায়ন হয়ে থাকে স্থানীয় সরকার কাঠামোর মধ্য দিয়ে। ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন নিয়ে গঠিত স্থানীয় সরকার কাঠামোর মাধ্যমে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। এই পাঁচটি স্তর পরিচালিত হয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে। গত বছর ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর স্থানীয় সরকার কাঠামো জনপ্রতিনিধিহীন হয়ে পড়েছে। ফলে সেবা কার্যক্রম অনেকটাই স্থিমিত হয়ে গেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। উন্নয়ন কাজ থমকে গেছে বলেও মনে করেন অনেকে।

গত ৫ আগস্টের পর জনপ্রতিনিধির জায়গায় বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা বসলেও তারা রুটিন কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যে কারণে গ্রামীণ ও শহুরে রাস্তা সংস্কারের কাজ এখন অনেকটাই বন্ধ। গ্রামের অধিকাংশ রাস্তার দশা বেহাল। এডিস মশার বিস্তার শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বেড়েছে। তা ছাড়া ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে জলাবদ্ধতার শঙ্কা রয়েছে বলে জানা গেছে। সার্বিক অবস্থা নিয়ে ক্ষুব্ধ সাধারণ নাগরিকরা।

জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল-অরুয়াইল সড়ক ব্যবহার অনুপযোগী। এতটাই খারাপ যে হেঁটেও যাওয়া যায় না। এটার সংস্কার শুরু হয়েছিল। অজ্ঞাত কারণে ৬ মাস ধরে কাজ বন্ধ। এলাকাবাসী এ নিয়ে মানববন্ধনও করেছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। কিন্তু বাজেট নেই বলে তারা কোনো কাজ ধরতে পারবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।

শহরের অবস্থাও তথৈবচ। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে কিছু কাজ হলেও নজর নেই অন্যান্য সিটি করপোরেশনে।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ আমাদের সময়কে বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের সফলতা নির্ভর করে স্থানীয় সরকার কাঠামোর ওপর। গ্রাম থেকে শহরে যে নেটওয়ার্ক বা জালের মাধ্যমে নাগরিকদের সেবা দেওয়া হয়, সেটা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। স্থানীয় সরকারে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে সব পর্যায়ের স্থানীয় সরকার কাঠামো পরিচালিত হচ্ছে, তা হলে ভেঙে পড়ার কারণ কীÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা চাকরিবিধি মেনে কাজ করেন। জনপ্রতিনিধির কাজ কখনও আমলাদের দিয়ে হয় না। জনপ্রতিনিধি সরাসরি জনগণের সঙ্গে

সম্পর্কিত। ফলে তাদের অভাব এই কর্মকর্তাদের দিয়ে পূরণ হবে না। এটা আপৎকালীন সময়ের জন্য ঠিক ছিল। এভাবে দীর্ঘদিন জনপ্রতিনিধি না থাকলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।

সারাদেশে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনেও জনপ্রতিনিধিহীন স্থানীয় সরকার কাঠামো দায়ী বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, গ্রামপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলার প্রথম পর্ব মীমাংসা হয় চেয়ারম্যান, মেম্বরদের মাধ্যমে। শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও পৌরসভা পর্যায়ে মেয়রদের ভূমিকা অনেক বেশি। জনপ্রতিনিধি না থাকায় অপরাধের প্রবণতা বেড়েছে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবোদয় এলাকার বাসিন্দা জামাল হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, আগে ছোটখাটো ঝামেলা হলে কাউন্সিলরের কাছে যেতাম। তারা সহযোগিতা করতেন। এখন খুন হলেও বিচার দেওয়ার জায়গা নেই। দুই দিন আগে নবোদয় বাজারের কাছে একজন ডিম ব্যবসায়ীকে দিনের বেলায় গুলি করে খুন করা হয়েছে। এ ঘটনায় কারও কাছে গিয়ে কাজ হচ্ছে না। অভিযোগ দেওয়ার জায়গা নেই। আমার একটা ওয়ারিশ সনদ দরকার ছিল, এক মাস ঘুরেও সেটা পাইনি।

এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান আমাদের সময়কে বলেন, শুধু সেবা নয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জনপ্রতিনিধিদের বড় ভূমিকা রয়েছে। স্থানীয় সরকার কাঠামোতে জনপ্রতিনিধি না থাকায় সব রকম সেবা ব্যাহত হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে সরকারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে। পুরো ব্যবস্থা চালু করতে পরবর্তী সরকারেরও ভোগান্তি হবে বলে মনে করেন তারা।