নতুন মুদ্রানীতিতে গুরুত্ব পাচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নতুন মুদ্রানীতির ভঙ্গিমা আগের মতোই সংকোচনমূলক থাকছে। এ জন্য নীতি সুদহারে কোনো পরিবর্তন না আনার ইঙ্গিত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ব্যাংকঋণের সুদহার আগামী ছয় মাস কমার আশা নেই। তবে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর স্বার্থে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে সুদের হার কমানোর দাবি জানানো হয়েছে। অর্থনীতিবিদরাও মনে করেন, বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে নীতি সুদহার কিছুটা কমানো যেতে পারে, যাতে কাক্সিক্ষত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যায়। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) এই মুদ্রানীতি আগামী ৩১ জুলাই ঘোষণা করবেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে মুদ্রানীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করা, যাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখাও মুদ্রানীতির অন্যতম কাজ। এসব বিষয় মাখায় রেখে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের মুদ্রানীতি প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকারসহ স্টেকহোল্ডারদের মতামত নেওয়া হয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পান ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ আমলে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তিন দফায় নীতি সুদহার বাড়ানোর ঘোষণা দেন। সেই সঙ্গে বৈদেশিক বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আনতে নতুন নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এতে মূল্যস্ফীতি যেমন কমে এসেছে, তেমনি বিনিময় হারেও এসেছে স্থিতিশীলতা। আবার ডলার সংকট কেটে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও ফিরেছে স্বস্তি।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, সর্বশেষ জুন মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমেছে, যা গত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। যদিও এই হার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যাশিত হারের চেয়ে এখনো বেশি। তাই মূল্যস্ফীতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রত্যাশিত হারে না আসা পর্যন্ত মুদ্রানীতির ভঙ্গিমা সংকোচনমূলক ধারাতেই রাখতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান আমাদের সময়কে বলেন, বিগত মুদ্রানীতি যখন ঘোষণা করা হয়, তখন তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন গভর্নর। এগুলো হলো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত করা, ডলার সংকট কাটানো ও বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আনা এবং মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের ঘরে নামিয়ে আনা। এর মধ্যে প্রথম দুটি স্থিতিশীল পর্যায়ে আছে। মূল্যস্ফীতিও কমে গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। তবে যে সীমায় নামিয়ে আনার প্রত্যাশা করা হয়েছিল, সেই সীমায় নামেনি। ফলে সংকোচনমূলক অবস্থান থেকে সরে আসার সুযোগ কম।
নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার সময় নীতি সুদহার ছিল ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। পরে তিন দফায় ৫০ বেসিস পয়েন্ট করে বাড়িয়ে তা ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়। এর প্রভাবে ব্যাংকঋণের সুদহার ইতোমধ্যে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যা সরাসরি প্রভাব ফেলছে বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে। এমন প্রেক্ষাপটে আগের মতো সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ থেকে বেরিয়ে আসার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু আমাদের সময়কে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন সংকুচিত মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে, যার অন্যতম কারণ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। অনেকের ধারণা, বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির জন্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি সত্য। এর মধ্যে একটা অংশ বিদেশে চলে যায়, কিছু লুকিয়ে রাখা হয়। আসলে দেশের অর্থনীতিতে মুদ্রার কী পরিমাণ সরবরাহ দরকার, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এ বিষয়ে একটা ফর্মুলা বের করার জন্য ১০ বছর ধরে বলে এসেছি। মূল্যস্ফীতি হওয়ার জন্য শুধু কি মুদ্রাস্ফীতি বাড়ানো একমাত্র কারণ, আমার তা মনে হয় না। বরং সংকোচিত মুদ্রানীতি অনুসরণ করার ফলে আমদানি ও বিনিযোগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে উৎপাদন কমে যাবে এবং সরবরাহে ঘাটতি বেড়ে যাবে। ফলে মূল্যস্ফীতি হবে। তাই মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য যদি আগের ধারাবাহিকতায় সংকোচিত মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হয়, তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির জন্য তা ভালো হবে না। কারণ আমাদের দেশে উৎপাদনের বেশিরভাগ পণ্য ও কাঁচামাল আমদানিনির্ভর।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
মূল্যস্ফীতি কমতির দিকে থাকায় নীতি সুদহার কিছুটা কমানোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভাবতে পারে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, নতুন মুদ্রানীতিতে খুব বেশি পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ মূলত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকেই অগ্রাধিকার দেবে। কারণ মূল্যস্ফীতি এখনো সীমার ওপরে রয়েছে, বিশেষত খাদ্য বহির্ভূত। যেটা দুশ্চিন্তার কারণ। তবে সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি আগের চেয়ে কমে এসেছে। এমন প্রেক্ষাপটে নীতি সুদহার কিছুটা কমানোর কথা ভাবা যেতে পারে। তবে আমার মনে হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে সাবধানতা অবলম্বন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রিজার্ভ এখন ভালো অবস্থানে। ডলারের বিনিময় হারেও স্থিতিশীলতা এসেছে। ফলে বিনিময় হারেও কোনো পরিবর্তন আনা হচ্ছে না। এ কারণে সম্প্রতি টাকা অতিমূল্যায়িত হওয়ার পর বাজার থেকে ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যাতে ১২২ টাকার মধ্যে স্থিতিশীল থাকে। কারণ এর সঙ্গে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের একটা সম্পর্ক আছে।