প্রাথমিক শিক্ষা সংস্কারে একগুচ্ছ উদ্যোগ

এম এইচ রবিন
২০ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
প্রাথমিক শিক্ষা সংস্কারে একগুচ্ছ উদ্যোগ

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় একদিকে যেমন সংস্কারের ছোঁয়া লাগছে, তেমনি মাঠ পর্যায়ের শিক্ষকরা আন্দোলনে নেমে পড়েছেন নানা বৈষম্যের অভিযোগে। অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ এ খাতকে এগিয়ে নেওয়ার বার্তা দিলেও শিক্ষকসমাজের মধ্যে অসন্তোষ ও বঞ্চনার ক্ষোভ গভীর হচ্ছে।

একগুচ্ছ সংস্কার উদ্যোগ : ২০২৫ সালের শুরুর দিকে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষা খাত, বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে নতুন করে গুরুত্বারোপ করেছে। এরই অংশ হিসেবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় একাধিক সংস্কারধর্মী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

প্রথমত দেশব্যাপী প্রায় ৩৭ হাজার নতুন শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক সংকটে ভোগা বিদ্যালয়গুলোর জন্য এটি নিঃসন্দেহে স্বস্তির বার্তা। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে ভারসাম্য ফিরবে বলে আশা করা হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতি নীতিমালা পর্যালোচনা করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনেক দিন ধরে আটকে থাকা পদোন্নতির বিষয়ে অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ ও মেধার ভিত্তিতে সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

তৃতীয়ত প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা পুনরায় চালু করার ঘোষণা এসেছে। বিতর্কিত হলেও এটি শিক্ষার্থীদের জন্য মূল্যায়নের একটি মাপকাঠি হয়ে উঠবে বলে মন্ত্রণালয়ের দাবি।

শিক্ষকসমাজের অভিযোগ ও আন্দোলন : তবে এসব উন্নয়ন উদ্যোগের আড়ালেই জমে উঠেছে প্রাথমিক শিক্ষকদের দীর্ঘদিন বঞ্চিত থাকার ক্ষোভ। শিক্ষক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, সরকার পদোন্নতির কথা বললেও বাস্তবে হাজার হাজার শিক্ষক বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করেও উচ্চপদে উন্নীত হতে পারছেন না।

আন্দোলনকারী প্রাথমিকের শিক্ষক মো. সাঈদ আবদুল্লাহ অভিযোগ করে বলেন, সহকারী শিক্ষকদের বেতন এখনও ১৩তম গ্রেডে, যা বর্তমান বাজার বাস্তবতায় জীবনযাত্রার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তাদের দাবি, কমপক্ষে ১০ম গ্রেডে উন্নীত করতে হবে যাতে শিক্ষকতা পেশা সামাজিকভাবে মর্যাদাপূর্ণ হয়ে ওঠে।

এ ছাড়া পদায়ন ও বদলিতে অনিয়ম, রাজনৈতিক প্রভাব, বিচারবহির্ভূত বদলি এবং অনুমোদনহীন বিষয়ে রেজিস্ট্রেশন করে শিক্ষার্থীদের ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়ার মতো অভিযোগ শিক্ষক আন্দোলনকে আরও জোরালো করেছে বলেও বক্তব্য এ শিক্ষক নেতার।

তিনি জানান, চলতি জুলাই মাসজুড়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকরা মানববন্ধন, কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত এক মহাসমাবেশে তারা চার দফা দাবি উত্থাপন করেছেনÑ বেতন গ্রেড উন্নয়ন, সময়োপযোগী পদোন্নতি, ন্যায্য পদায়ন ও হয়রানিমুক্ত প্রশাসনিক আচরণ।

প্রশাসনের অবস্থান : প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শিক্ষকদের দাবিগুলো পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের বিষয়েও নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে শিক্ষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে এমন প্রতিশ্রুতি তারা শুনে আসছেন, কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

শিক্ষাবিদদের পরামর্শ : শিক্ষাবিদরা মনে করেন, সরকারের সংস্কার উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও তা শুধু কাগুজে সিদ্ধান্তে সীমাবদ্ধ থাকলে শিক্ষকদের আস্থা ফেরানো যাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. ফারজানা হক বলেন, প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে শিক্ষকদের মর্যাদা, ন্যায্য বেতন কাঠামো এবং স্বচ্ছ প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিশ্চিত না করলে প্রকৃত পরিবর্তন সম্ভব নয়।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা খাতে একটি চিত্র স্পষ্ট- একদিকে নীতিনির্ধারকরা পরিবর্তনের বার্তা দিচ্ছেন, অন্যদিকে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষকরা নিজেদের বঞ্চিত ও উপেক্ষিত মনে করছেন। এ দূরত্ব ঘোচাতে হলে কেবল নিয়োগ বা পরীক্ষার ঘোষণা নয়, বরং শিক্ষকদের প্রতি সম্মান, ন্যায্যতা ও আস্থার পরিবেশ তৈরি করাই হবে প্রকৃত সংস্কার।