চিরুনি অভিযানের প্রভাব মাঠে নেই

শাহজাহান আকন্দ শুভ ও সাজ্জাদ মাহমুদ খান
১৯ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
চিরুনি অভিযানের প্রভাব মাঠে নেই

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির প্রেক্ষাপটে অপারেশন ডেভিল হান্টের পর শুরু হয়েছে চিরুনি অভিযান। অভিযানের এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও মাঠপর্যায়ে এর দৃশ্যমান প্রভাব খুব একটা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। চিরুনি অভিযান ঘোষণার আগে এবং পরে আসামি গ্রেপ্তার ও অপরাধ পরিসংখ্যানেও তেমন পরিবর্তনও হয়নি। চিরুনি অভিযানের মধ্যেই গত বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও আদাবরে এক ঘণ্টার ব্যবধানে দুজনকে হত্যা করা হয়। একই দিন গোপালগঞ্জে এনসিপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হয়। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ৪ জন নিহত হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল আরও একজন মারা যান।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকার ঘোষণা দিয়েই চিরুনি অভিযান শুরু করেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু হওয়ার পর সব ধরনের অপরাধীর মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। তখন র‌্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা তৎপরতাও চোখে পড়েছিল। কিন্তু এবার চিরুনি অভিযানে সেই চিত্র চোখে পড়ছে না। ফলে এই অভিযানের মধ্যেই দুষ্কৃতকারীরা নানা অপরাধের সাহস দেখাচ্ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের গ্রেপ্তার ও উদ্ধারসংক্রান্ত পরিসংখ্যান বলছে, মিটফোর্ডে পাথর দিয়ে ব্যবসায়ীকে হত্যার পর গত ১৩ জুলাই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা চিরুনি অভিযানের ঘোষণা দেন। সেই থেকে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত ৬ দিনের অভিযানে ৯ হাজার ৭৩৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। একই সময় আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয় ২৬টি। তবে চিরুনি অভিযানের আগের ছয় দিনে (৭-১২ জুলাই) পুলিশের অভিযানে ৯ হাজার ৭০৯ জন গ্রেপ্তার ও ২১টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। অর্থাৎ চিরুনি অভিযানে আগের ছয় দিন ও পরের ছয় দিনে গ্র্রেপ্তার ও অস্ত্র উদ্ধারে তেমন পার্থক্য নেই।

তবে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেছেন, গ্রেপ্তারের সংখ্যা বৃদ্ধি নয়, অভিযান চালানো হচ্ছে চিহ্নিত অপরাধীদের গ্রেপ্তারের লক্ষ্য নিয়ে। সামনে ভালো ফল পাওয়া যাবে বলে তারা আশা প্রকাশ করেছেন।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক আমাদের সময়কে বলেন, চিরুনি অভিযানে প্রাপ্তি প্রায় শূন্যের কোঠায়। এর মূল কারণ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে পুলিশ ও জনগণের মধ্যে যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছিল, তা এখনও কাটেনি। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে এই আস্থার সংকট কাটাতে হবে, তাদের মনোবল বাড়াতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে অপরাধের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।

অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক দলের ভূমিকার বিষয়ে অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে পুলিশকে ব্যবহারের কারণেই বাহিনীটির আজকে এই অবস্থা। দুঃখের বিষয় হলো, রাজনৈতিক দলগুলো এই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন নয়, তারা ব্যস্ত নির্বাচন আর ক্ষমতা নিয়ে। পুলিশের সমস্যা রাজনৈতিকভাবে তৈরি হয়েছে, সমাধানও রাজনৈতিকভাবে হতে হবে।

মাঠ পুলিশ বলছে, পুলিশের চেইন অব কমান্ড অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছে। কারও দায়িত্ব কেউ নিতে চাচ্ছে না। মাঠে কেউ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করলে কোনো ভুল হলে সে জন্য শাস্তি কিংবা বদলির সমস্যা বহন করতে হবে। এখনও ভয় কাটেনি অনেক পুলিশ সদস্যের। এই ভীতি থেকেও অনেকেই কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে পারছেন না। তবে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে পুলিশ সদর দপ্তর নানা পদক্ষেপ নিলেও তাদের মনোবল এখনও কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছেনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘মব’ সৃষ্টি করে একের পর এক নৈরাজ্য ও নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনায় রাজধানীসহ সারাদেশে ‘চিরুনি অভিযান’র সিদ্ধান্ত হয়। অভিযানে চিহ্নিত চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, মব সৃষ্টিকারী, ছিনতাইকারী, ডাকাত ও মাদককারবারিদের গ্রেপ্তারের টার্গেট নেওয়া হয়। গত রবিবার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ‘চিরুনি অভিযান’ শুরু করার কথা জানান।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে গাজীপুরে সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ওপর হামলা চালানো হয়। এতে ২০ শিক্ষার্থী আহত হন এবং একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ওই ঘটনার পরদিন ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে গাজীপুরসহ সারাদেশে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ১ মার্চ পর্যন্ত এই অভিযানে প্রায় ১২ হাজার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই সময়ে সারাদেশে মোট গ্রেপ্তার করা হয় ৩০ হাজার ৭২৩ জনকে। তবে ১ মার্চের পর অপারেশন ডেভিল হান্ট কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।

ডেভিল হান্টের শুরুতে পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নানা তৎপরতা শুরু করেছিল। তখন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চেকপোস্ট স্থাপন করে ব্যাপক তল্লাশি কার্যক্রম দেখা গিয়েছিল। র‌্যাব-পুলিশের টহল টিমের সংখ্যাও বাড়ানো হয়। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে আইনশৃঙ্খলায়। এতে অপরাধীদের মধ্যেও এক রকম আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। যদিও সেই অভিযানও দুই সপ্তাহ পর ঢিলেঢালা হয়ে যায়।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর আমাদের সময়কে বলেন, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান জোরদার করা হয়েছে। অপরাধীরা ধরাও পড়ছে। এই মুহূর্তে অপরাধের মাত্রাও কমে এসেছে। অপরাধীদের কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।

এদিকে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পুলিশ সদর দপ্তরে পুলিশপ্রধান বাহারুল আলমের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় চিহ্নিত সন্ত্রাসী, অবৈধ অস্ত্রধারী, চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী, ডাকাতসহ আইনশৃঙ্খলা বিঘœকারী অপরাধীদের বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযানের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। হাতেনাতে কোনো চাঁদাবাজ ধরা পড়লে তাকে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটকাদেশ বা ডিটেনশন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে। কোনো ভুক্তভোগী মামলার বাদী হতে না চাইলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ওইদিন রাতেই পুলিশের সব ইউনিটকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়।