পটপরিবর্তনের পরও কমেনি খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল
ব্যাংক খাতে সংস্কারমূলক নানা পদক্ষেপের মধ্যেও খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল (নবায়ন) বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যা গত বছর একই সময়ের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি। আগের তিন মাসেও রেকর্ড পরিমাণ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। অর্থাৎ, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের গতি কমেনি। তারপরও লাগামহীনভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ, যা এরই মধ্যে ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের আসল চিত্র বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। এ কারণে পুনঃতফসিল বাড়িয়ে সেটি কিছুটা হলেও কমানোর চেষ্টা করছে ব্যাংকগুলো। বিশেষ করে বিগত সরকারের সময়ে দেওয়া নানা ছাড়, নীতিমালায় শিথিলতা আনা এবং ব্যাংকের হাতে পুনঃতফসিলের পুরো ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার কারণে খেলাপিদের এই ধরনের সুবিধা দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এই প্রবণতা রোধে আগের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে ক্ষমতা নেওয়ার পরামর্শ দেন তারা।
জানা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে নানারকম ছাড় দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ২০২২ সালের জুলাইয়ে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের পুরো ক্ষমতাই ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর ব্যাংকগুলোর হাতে ক্ষমতা যাওয়ার পর থেকে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল বেড়েছে। কারণ, ব্যাংকের পর্ষদই এখন খেলাপি ঋণ নবায়নের সিদ্ধান্ত দিতে পারছে। আবার রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা আসার কারণেও ঋণ নিয়মিত রাখতে পুনঃতফসিল সুবিধা দিতে বাধ্য হচ্ছে ব্যাংকগুলো। এ ছাড়া বিগত সরকারের সময়ে এ সংক্রান্ত নীতিমালাও শিথিল করা হয়। যেমন, বর্তমানে ঋণ পুনঃতফসিলে মাত্র আড়াই থেকে সাড়ে চার শতাংশ অর্থ জমা দিলেই হয়, আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। এসব ঋণ পরিশোধে গ্রাহকদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে পাঁচ থেকে আট বছর, যা আগে সর্বোচ্চ তিন বছর ছিল। বিশেষ বিবেচনায় কোনো খেলাপি ঋণ চারবার পর্যন্ত পুনঃতফসিলের সুযোগ রাখা হয়েছে, আগে তিনবারের বেশি পুনঃতফসিল করা যেত না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল মানে হলো, খেলাপিদের এক ধরনের ছাড় দেওয়া। আমরা দেখেছি, বারবারই খেলাপিদের এ ধরনের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই সুবিধা পেয়েও তারা ঋণ ফেরত দিচ্ছে না। উল্টো যে ঋণগুলো পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করা হচ্ছে, পরিশোধ না করায় আবার তা খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। তাই যারা ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করে তালবাহানা করেন, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, আগে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি নিতে হতো। ২০২২ সালের জুলাইয়ের পর এই ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ বৃদ্ধির এটাই অন্যতম কারণ। কেন না, ব্যাংকগুলো এখন নিজেদের মতো করে ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারছে। তাই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষমতা আগের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চÑ এই তিন মাসে ব্যাংকগুলো ৭ হাজার ৯০৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। গত বছর একই সময়ে পুনঃতফসিল করেছিল ২ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে গত তিন মাসে পুনঃতফসিল ঋণ বেড়েছে ৫ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। আগের তিন মাসেও (২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর) রেকর্ড পরিমান খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছিল ব্যাংকগুলো। ওই সময়ে পুনঃতফসিল করা হয় ৩৫ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানান, বছরের শেষ প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখাতে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলে ঝুঁক থাকে। যার ফলে বছরের শেষ তিন মাস পুনঃতফসিলের পরিমাণ অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। যেমন, ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসেও রেকর্ড পরিমাণ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছিল ব্যাংকগুলো। ওই তিন মাসে পুনঃতফসিল করা ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা। তবে বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) তা আবার স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালে ব্যাংকগুলো রেকর্ড ৯১ হাজার ২২১ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে। এর অধিকাংশই করা হয় ওই বছর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সময়ের মধ্যে। এর জন্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে দায়ী করা হয়েছিল। কারণ, নির্বাচনে প্রার্থী হতে ওই বছরের শেষ দিকে অনেক প্রার্থীই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত হন। এ ছাড়া নিজেদের আর্থিক হিসাব ভালো দেখাতেও শেষ প্রান্তিকে অনেক খেলাপি গ্রাহকের ঋণ উদার হস্তে নবায়ন করেছিল ব্যাংকগুলো।
তবে ব্যাংক খাতে পুনঃতফসিল বাড়িয়েও খেলাপি ঋণ কমানো যাচ্ছে না। চলতি বছর প্রথম তিন মাসেই (জানুয়ারি-মার্চ) খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৭৪ হাজার কোটি টাকা। আগের তিন মাসে বেড়েছিল (অক্টোবর-ডিসেম্বর) প্রায় ৬১ হাজার কোটি টাকা। এতে চলতি বছর মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। শুধু পরিমাণের ভিত্তিতেই নয়, শতকরা হিসাবেও বেড়েছে খেলাপি ঋণ। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের হার ছিল ২০.২০ শতাংশ, মার্চে বেড়ে হয়েছে ২৪.১৩ শতাংশ। ব্যাংকাররা জানান, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যাংক খাত সংস্কারে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে লাফিয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, খেলাপি ঋণের কোনো তথ্য লুকিয়ে রাখা হবে না। সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর পর এটা আদায় জোরদার করা হবে এবং এভাবে খেলাপি ঋণ কমানো হবে। নতুন করে বিতরণ করা ঋণ যেন আর খেলাপি না হয়, সেজন্য বিভিন্ন আইনি কঠোরতা আনার কথাও জানান তিনি।