সমঝোতায় পৌঁছাতে মরিয়া ঢাকা

আরিফুজ্জামান মামুন ও আবু আলী
১১ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
সমঝোতায় পৌঁছাতে মরিয়া ঢাকা

ওয়াশিংটন ডিসিতে বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে ব্যস্ত। দ্বিতীয় দফার তিন দিনব্যাপী আলোচনা এরই মধ্যে শেষের পথে, তবে এখনও কোনো চূড়ান্ত চুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হয়নি। আলোচনার প্রতিটি পর্বেই যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাড়তি পাল্টা শুল্কের ধাক্কা সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে কোনো মূল্যে সমঝোতায় পৌঁছাতে চায় ঢাকা।

বাংলাদেশের তরফে সর্বোচ্চ ছাড়ের মানসিকতা নিয়ে আলোচনা চলছে। ট্রাম্প প্রশাসনের মন পেতে এরই মধ্যে ২০ থেকে ২৫ ডলার বেশি দাম দিয়ে ৩ লাখ টন গম কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বোয়িং উড়োজাহাজ কেনার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং তুলা আমদানি বাড়ানোরও চেষ্টা চলছে। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা বেশির ভাগ পণ্যের ওপর শুল্কহার শূন্য ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ। এসব উদ্যোগের মূল লক্ষ্য, যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্য ঘাটতি ও পাল্টা শুল্কের ঝুঁকি কমান। 

প্রথম দফা আলোচনার পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বোয়িং, খাদ্য ও সামরিক সরঞ্জাম আমদানি করার এবং আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক, ভ্যাট ও ডিউটি ধাপে ধাপে কমানোর প্রস্তাব দেওয়া হয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় নতুন কোনো বড় বাণিজ্য সুবিধা যুক্তরাষ্ট্রকে দিতে না পারায় চুক্তির সম্ভাবনা ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। দ্বিতীয় দফা আলোচনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা জানান, আমরা আলোচনায় যুক্তি তুলে ধরেছি, মার্কিন পক্ষ মনোযোগ দিয়েছে, কিন্তু এখনও তারা চূড়ান্ত মত দেয়নি।

বাংলাদেশ থেকে গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে ৮৩৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হয়েছে ২২১ কোটি ডলারের পণ্য। গত ৩ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ করেই বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করে, যা বর্তমানে কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হলেও এই হার আগামী ১ আগস্ট থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত সপ্তাহে বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশের ওপর নতুন করে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন।

এ শুল্ক কার্যকর হলে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশে মারাত্মক প্রতিযোগিতাহীনতায় পড়বে। এই ঘাটতি কমাতে এবং ট্রাম্প প্রশাসনের আস্থা অর্জনে বাংলাদেশ একতরফাভাবে মার্কিনপন্থি বাণিজ্যনীতি গ্রহণ করেছে। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তর ইউএসটিআরের সঙ্গে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তিতে পৌঁছানো যায়নি। আলোচনায় অংশ নিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন। ঢাকা থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত থাকছেন নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়ব। প্রতিনিধি দলে আরও আছেন বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান, অতিরিক্ত সচিব ডা. নাজনীন কাওসার ও যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স সালাহউদ্দিন মাহমুদ। দ্বিতীয় দফা আলোচনায় মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশ দলের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তিন মাস আগে ট্রাম্পকে চিঠি লিখে শুল্কহার কমানোর অনুরোধ জানিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টাও আলাদা করে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিকে চিঠি দেন। কিন্তু বিশেষ সুবিধা আদায়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। লবিস্ট নিয়োগের দাবিও উঠেছে রপ্তানিকারকদের পক্ষ থেকে।

এদিকে তুলনামূলকভাবে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় সাফল্য পেয়েছে। দেশটি অতিরিক্ত আমেরিকান পণ্য আমদানি এবং চীনা পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০ শতাংশ ট্যারিফ চুক্তি সম্পন্ন করেছে। শুধু তাই নয়, ভিয়েতনামের পক্ষ থেকে ট্রাম্প অর্গানাইজেশনের বিলাসবহুল রিসোর্ট প্রকল্পেও সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। ফলে কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে তারা অনেকটাই এগিয়ে আছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট জানিয়েছেন, চলতি বছর দেশটি শুল্ক থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলারের রাজস্ব আয় করেছে এবং এই আয় ২০২৫ সালের শেষে ৩০ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছাতে পারে। অর্থাৎ, ট্রাম্পের শুল্কনীতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য রাজস্ব বাড়ানোর বড় হাতিয়ার হয়ে উঠছে, যা তাকে রাজনৈতিকভাবেও শক্তিশালী করছে। হোয়াইট হাউসের এক রিপোর্ট বলছে, শুল্ক বাড়ানোর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বাড়েনি, বরং আমদানি করা পণ্যের দাম কমেছে।

এদিকে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের বিষয়ে ‘দরকাষাকষির আলোচনায় যোগ্য ব্যক্তিদের রাখা’র পরামর্শ দিয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের এক আলোচনা সভায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি এই আহ্বান জানানো হয়। 

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ ট্যারিফ আরোপ করেছে। আমরা প্রধানত রপ্তানি করি তৈরি পোশাক; এর ওপর যদি ৩৫ শতাংশ ট্যারিফ আসে, তাহলে এই পোশাক শিল্প মাটিতে শুয়ে পড়তে পারে, উঠতে পারবে না। তাতে আমাদের অর্থনীতির মেরুদ- ভেঙে যাবে। অন্তর্বর্তী সরকার এ ব্যাপারে কতটুকু মনোযোগ দিয়েছে, আমি জানি না। অনেক বেশি মনোযোগ দিয়ে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের এ সম্পর্কে বার্গেইন করে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কাজ করার প্রয়োজন ছিল। এ বিষয়গুলো আলোচনার সময় এখনও আছে। আমাদের ইন্ডাস্ট্রি যাতে বেঁচে থাকে, আমাদের মেয়েদের কর্মসংস্থান যাতে নষ্ট না হয়, আমাদের অর্থনীতি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়Ñ এটা তারা অবশ্যই দেখবেন।

মার্কিন প্রতিনিধির সঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টার সাক্ষাৎ

বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বসির উদ্দিন ওয়াশিংটনে মার্কিন বাণিজ্য বিষয়ক প্রতিনিধি দূত জেমিসন গ্রির সঙ্গে গতকাল তার কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেছেন। এ সময় উভয় নেতা বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য এবং চলমান শুল্ক ইস্যুতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পারস্পারিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন বলে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।

উভয় পক্ষ যৌথ স্বার্থে কাজ চালিয়ে যেতে তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। এদিন বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিতীয় ধাপের তিন দিন ব্যাপী শুল্ক আলোচনার দ্বিতীয় দিনে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কের প্রায় সকল বিষয় বিস্তারিত আলাপে স্থান পায়।

ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বসির উদ্দিন। এছাড়া জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার আইসিটি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব আলহয়, আমাদের অর্থনীতি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়- এটা তারা অবশ্যই দেখবেন।