অতিরিক্ত সতর্কতায় উন্নয়ন প্রকল্পের সিদ্ধান্তে ধীরগতি

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত

লুৎফর রহমান কাকন
১০ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
অতিরিক্ত সতর্কতায় উন্নয়ন প্রকল্পের সিদ্ধান্তে ধীরগতি

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বড় কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে না অন্তর্বর্তী সরকার। এমনকি বিতর্কিত হতে পারে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকেও দূরে থাকছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের অধীনস্থ কোম্পানিগুলোও চলছে অনেকটা রুটিনমাফিক কাজ করে। ফলে স্বাভাবিক রুটিনওয়ার্ক করছে মন্ত্রণালয়, কোম্পানিগুলো। অন্তর্বর্তী সরকার আগের সরকারের নেওয়া অনেক প্রকল্প কাটছাঁট করেছে। যেসব প্রকল্পকে প্রয়োজনের চেয়ে ব্যয়বহুল মনে হয়েছে, সেগুলো স্থগিত রেখেছে। তবে অতিরিক্ত সতর্কতার কারণে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তও আসছে না বলে মনে করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বেশ কয়েকটি কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা। এদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সংস্কারে একাধিক কমিটি গঠন করা হলেও চূড়ান্ত সুপারিশ আসছে কম।  

একটি বিদ্যুৎ কোম্পানির এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের সময়কে বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প ছাড়াও কোম্পানিগুলোর অনেক অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তের বিষয় আছে। কোম্পানির বোর্ড চেয়ারম্যানরা সেগুলো দ্রুত দিতে পারছেন না। কোম্পানির বোর্ড মিটিংয়ে একডজন ইস্যু থাকলে একটা-দুটো পাস হচ্ছে। বাকিগুলো ঘুরছে দিনের পর দিন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জ্বালানি খাতের একাধিক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, কোম্পানির যে কোনো বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয় বোর্ড থেকে। বাস্তবতা হচ্ছে, বোর্ডগুলো অধিকাংশ সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না। নানা জটিলতার বিষয় চিন্তা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে না। ফলে কোম্পানির গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক কার্যক্রমে গতি ধীর হচ্ছে। আমরা মূলত মন্ত্রণালয় বা বোর্ডের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারি। কিন্তু ওপর দিক থেকে দ্রুত সিদ্ধান্ত না এলে আমাদেরও ধীরগতিতে চলতে হয়।

জ্বালানি বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, বড় সিদ্ধান্ত আসতে হবে উপদেষ্টার দপ্তর বা প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উন্নয়ন প্রকল্পের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না। আমি মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হলো- মূলত স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে নেওয়া। রাজনৈতিক সরকার ছাড়া ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট হবে না। তবে এখন অনেকগুলো কমিটি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সংস্কারের বিষয়ে কাজ করছে। সব কমিটির চূড়ান্ত সুপারিশ আসেনি। সেগুলো বাস্তবায়নে কাজ করবে মন্ত্রণালয়। 

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজাউল করিম আমাদের সময়কে বলেন, পিডিবির আর নতুন বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করার দরকার নেই। আগের সরকারই এমন অনেক প্রকল্প রেখে গেছে, যার অনেকগুলোর দরকার ছিল না। আমরা এখন আগের অনেক প্রকল্পের ট্যারিফ সংশোধনের কাজ করছি। এটি করতে পারলে বড় কাজ হবে। বিদ্যুৎ বিভাগ এখন নাবায়ণযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্প্রসারণ বা নবায়ণযোগ্য খাত থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেশি মনোযোগ দিয়েছে।  

প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক আদালতে ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির পর সর্বমোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটারের বেশি সমুদ্র অঞ্চলের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের। সেই সম্ভাবনাময় সমুদ্রাঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে বিগত সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এদিকে মিয়ানমার দীর্ঘদিন ধরেই তাদের সমুদ্রের অংশ থেকে গ্যাস উত্তোলন করছে। 

এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজানুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, একবার দরপত্র আহ্বান করার পর কেউ অংশগ্রহণ করেনি। ফলে তড়িঘড়ি না করে দ্বিতীয় দফায় দরপত্র আহ্বানের ক্ষেত্রে সরকার সময় নিচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। আগ্রহী পাওয়া গেলে তখন দরপত্র আহ্বান করা হবে।

এদিকে দেশের গ্যাস সংকট মেটাতে আগের সরকারের পথেই হাঁটছে বর্তমান সরকার। বেশি করে এলএনজি আমদানির দিকে ঝুঁকছে। বিগত সরকার একশ নতুন কূপ খননের প্রকল্প হাতে নিলেও সেটি অত্যন্ত ধীরগতিতে এগিয়েছে। পেট্রোবাংলার একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার প্রথমে একশ নতুন কূপ খননের প্রকল্পটি বাদ দিতে চাইলেও পরে গুরুত্ব বুঝে তা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে সেটিও চলছে ধীরগতিতে। 

দেশে ৮টি গ্রাহক শ্রেণিতে প্রতিদিন অনুমোদিত গ্যাসের লোড রয়েছে ৫ হাজার ৩৫৬ মিলিয়ন ঘনফুট, প্রকৃত চাহিদা ধারণা করা হয় ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদার বিপরীতে দৈনিক ২ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে, আর ঘাটতি থেকে যাচ্ছে প্রায় ১ হাজার ২০০ মিলিয়নের মতো। একদিকে প্রতিনিয়ত দেশীয় গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ছে চাহিদা। এক সময় ২৮০০ মিলিয়ন উৎপাদন হলেও এখন ১৮০০ মিলিয়নে নেমে এসেছে।

এদিকে শিল্প-কারখানাগুলো প্রচ- গ্যাস সংকটে ভুগছে। গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাসের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, কোম্পানির বোর্ড চেয়ারম্যান আরেক বিভাগের সচিব হওয়ায় জটিলতা বেড়েছে। গ্যাসের সংযোগ, লোডবৃদ্ধি, পুনঃসংযোগ এসব বিষয়ে জ্বালানি বিভাগ থেকে একাধিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। ফলে গ্রাহকরা পড়েছে চরম আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়। 

নিজস্ব উৎস থেকে গ্যাসের উৎপাদন কমে গেলে আমদানিই ভরসা। তবে আমদানি বাড়াতে হলে নতুন এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করতে হবে। ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনে কমপক্ষে দুই বছর আর ল্যান্ডবেজড টার্মিনালের জন্য ৮০ মালাগবে। তবে জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নতুন টার্মিনাল স্থাপনের কোনো কার্যক্রম নেই।