সাবেক ভূমিমন্ত্রীকে ১৮ কোটি টাকা ঘুষ দেয় সাইফ পাওয়ার
চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনায় বিতর্কিত কোম্পানি সাইফ পাওয়ারটেক এবং এর স্বার্থসংশ্লিষ্ট দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর প্রতিষ্ঠানে ১৮ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন অবৈধ সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে বিভিন্ন খাতে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নিতে এ অর্থ ঘুষ হিসেবে প্রদান করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধানে এমন প্রমাণ মিলেছে।
জানা গেছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, তরফদার রুহুল আমিনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের ৫টি কোম্পানিতে ২০২০ সালে ১৩টি লেনদেনের মাধ্যমে ১৮ কোটি ৮ লাখ টাকা প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদক সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং,
ডিজিটাল ভূমি রেকর্ডসহ নানা খাতে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নিতে ওই টাকা ঘুষ হিসেবে প্রদান করা হয়। ঘুষের বিনিময়ে অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিতে বাদ দিয়ে সে সময় সরকারের উচ্চমহল থেকে সাইফ পাওয়ারটেক এবং এর স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা প্রদান করা হয়। সম্প্রতি বন্দরের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনা থেকে সাইফ পাওয়ারটেককে বাদ দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড থেকে ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট তিনটি লেনদেনে সাইফুজ্জামানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট তিনটি প্রতিষ্ঠান ইমপেরিয়াল ট্রেডিং, মডেল ট্রেডিং ও ক্লাসিক ট্রেডিংয়ে যথাক্রমে এক কোটি ৫০ লাখ, এক কোটি ৭৫ লাখ এবং এক কোটি ৭৫ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়। একই বছরের ১ সেপ্টেম্বর সাইফ পাওয়ারটেক থেকে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ক্রিসেন্ট ট্রেডিংয়ের অ্যাকাউন্টে এক কোটি ৬০ লাখ টাকা ও ক্লাসিক ট্রেডিংয়ে এক কোটি ৭০ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়। পরদিন ২ সেপ্টেম্বর সাইফ পাওয়ারটেক থেকে ক্লাসিক ট্রেডিংয়ে এক কোটি ৪০ লাখ, ইমপেরিয়ালে এক কোটি, মডেল ট্রেডিংয়ে এক কোটি এবং ক্রিসেন্ট ট্রেডিংয়ে এক কোটি ৬০ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়। একই বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর সাইফ পাওয়ার লিমিটেড থেকে ইমপেরিয়াল ট্রেডিংয়ে আরও এক কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়।
এর আগে ২০২০ সালের ৯ মার্চ সাইফুজ্জামান চৌধুরীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ক্রিসেন্ট ট্রেডিংয়ে এক কোটি ৫৫ লাখ টাকা, ক্লাসিক ট্রেডিংয়ে এক কোটি ৫ লাখ টাকা এবং ইমিনেন্ট ট্রেডিংয়ে এক কোটি ৪৫ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয় ই-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি থেকে। এই কোম্পানির চেয়ারম্যান তরফদার রুহুল আমিন।
এসব অভিযোগে আগামী ১৪ জুলাই রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদক প্রধান কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছে তরফদার রুহুল আমিনকে। দুদকের উপ-পরিচালক মো. মশিউর রহমানের নেতৃত্বে একটি টিম এ সংক্রান্ত অনুসন্ধান করছে।
তরফদার রুহুল আমিনকে তলবের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, অভিযোগের বিষয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ প্রদানের জন্যই অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে তার বক্তব্য প্রদানের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তিনি এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। আর তিনি যদি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ গ্রহণ না করেন, সে ক্ষেত্রে অনুসন্ধান কর্মকর্তা বিধি অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিনের সঙ্গে গত শুক্রবার আমাদের সময়ের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। সে সময় তিনি ঢাকার বাইরে অবস্থান করছেন জানিয়ে বলেন, বিষয়টি দেখে বলতে হবে। সোমবার অফিস খুললে জানাতে পারব। এরপর তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। পরবর্তীতে মোবাইলে একাধিকবার ফোন, খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি জবাব দেননি।
এর আগে ২০২০ সালে রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ আসে। ওই সময় তার বিরুদ্ধে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে প্রভাবিত করে চট্টগ্রাম বন্দরে একচেটিয়া বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা করে এবং রাজস্ব ফাঁকির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগ আনা হয়। তখন ওই অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের তৎকালীন সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীনকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেয় কমিশন। তিনি তখন রুহুল আমিনকে জিজ্ঞাসাবাদও করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে এ অনুসন্ধান আর আলোর মুখ দেখেনি।
চট্টগ্রাম বন্দরের যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ কাজের মাধ্যমে ২০০৫ সালে সাইফ পাওয়ারটেক যাত্রা শুরু করেছিল। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দলটির শীর্ষনেতাদের যোগসাজশে প্রতিষ্ঠানটি বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংসহ নানা খাতে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। অভিযোগ রয়েছে, সরকারের উচ্চমহলের সিদ্ধান্তে বন্দর কর্তৃপক্ষ টেন্ডার ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বছরের পর বছর চুক্তি নবায়ন করেছে। আবার কখনও টেন্ডার হলেও নীতিমালায় এমন সব শর্ত জুড়ে দেওয়া হতো, যাতে সাইফ পাওয়ারটেক ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারে। সম্প্রতি বন্দরের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনা থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে সাইফ পাওয়ারটেককে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন