৮ মাস ধরে অকার্যকর মানবাধিকার কমিশন

শাহজাহান আকন্দ শুভ
০৯ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
৮ মাস ধরে অকার্যকর মানবাধিকার কমিশন

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) চেয়ারম্যান, সার্বক্ষণিক সদস্য এবং অন্য সদস্যরা নেই গত ৮ মাস। ২০২৪ সালের ৭ নভেম্বর তারা একযোগে পদত্যাগ করেন। এরপর থেকে কার্যত অচল হয়ে আছে রাষ্ট্রীয় এই সংস্থাটি। নতুন নিয়োগ না হওয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ব্যক্তিরা সংস্থাটিতে লিখিত অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। তাদের কাছ থেকে পাওয়া অভিযোগগুলো কেবল ফাইলবন্দি করে রাখা হচ্ছে পরবর্তী কমিশনের অপেক্ষায়। কিন্তু কবে নতুন কমিশন দায়িত্ব নেবে- এ ব্যাপারে সংস্থাটির কর্মকর্তারা কিছু বলতে পারেননি।

কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের আগস্টে দেশে ক্ষমতার পালাবদলের পর বিভিন্ন সাংবিধানিক কমিশন থেকে একের পর এক পদত্যাগ করেন কমিশন প্রধান ও সদস্যরা। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছরের ৭ নভেম্বর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ, সার্বক্ষণিক সদস্য মো. সেলিম রেজা এবং অন্য সদস্যরা পদত্যাগ করেন। তখন থেকে গতকাল পর্যন্ত কমিশনে ২৯২টি অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে তদন্ত ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার না থাকায় কমিশনের সচিবালয় কেবল অভিযোগ গ্রহণ করে সংরক্ষণ করছে।

বিচার প্রক্রিয়ার দায়িত্বে থাকা চারটি বেঞ্চও সদস্য সংকটে অচল হয়ে পড়েছে। কমিশনের দায়িত্বশীলরা জানান, কমিশনে আসা অভিযোগগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চারটি বেঞ্চ রয়েছে। বেঞ্চগুলো অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের নির্দেশনা দিত। কিন্তু কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা না থাকায় এগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে আছে।

নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার বাসিন্দা মো. শহিদুল্লাহ দৈনিক আমাদের সময়কে জানান, শীতলক্ষ্যা নদী পারাপার করতে ঘাটে পল্টন ও জেটি না থাকায় জনগণ প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। এজন্য তিনি দুই পারেই পল্টন ও জেটি নির্মাণের জন্য প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে জনস্বার্থমূলক আবেদন করেন। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তিনি দুই মাস আগে মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ করেন। তবে কমিশন অকার্যকর থাকায় অভিযোগটি কোনো তদন্তেই যায়নি।

শুধু শহিদুল্লাহই নয়, গত ৭ নভেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত যত ভুক্তভোগী সংস্থাটিতে অভিযোগ করেছেন, তারাও কোনো প্রতিকার পাননি। অভিযোগের বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে তাদের কেবল আশার বাণী শোনানো হয়। আবার কমিশন জনস্বার্থে বিভিন্ন ইস্যুতে সুয়োমোটো তদন্ত করে সরকারকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে বলত, সেই কার্যক্রমও বন্ধ। তবে কমিশনের অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান থেকে চাহিদা মতো তথ্য প্রদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উপপরিচালক ফারহানা সাঈদ বলেন, নতুন নিয়োগ না হওয়ায় কমিশন সচিবালয়ের পক্ষে তদন্ত কিংবা সুপারিশমূলক কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব নয়। কবে নাগাদ মানবাধিকার কমিশনে নতুন চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ করা হবে জানতে চাইলে লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিব হাফিজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ বিষয়ে তার কাছে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।

এদিকে একই বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, মানবাধিকার কমিশনের বিদ্যমান আইনটি সংশোধনের প্রক্রিয়া চলমান। এ প্রক্রিয়া শেষ হলেই নতুন কমিশন নিয়োগ করবে সরকার। এ ব্যাপারে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানাবেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।

মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির বলেন, আট মাসেও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে নতুন চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ না হওয়া খুবই দুঃখজনক। যত দ্রুত সম্ভব কমিশনে নতুন নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে সংস্থাটি দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর বিষয়ে ভূমিকা নিতে পারবে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯ অনুযায়ী একজন চেয়ারম্যান, একজন সার্বক্ষণিক সদস্য এবং ৫ জন অবৈতনিক সদস্যের সমন্বয়ে মানবাধিকার কমিশন গঠনের বিধান রয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে সরাসরি কোনো দ- দেওয়ার ক্ষমতা এই কমিশনের নেই। তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর বিষয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ করতে পারে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমসহ বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার ক্ষেত্রে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। তবে ২০১১ সালে র‌্যাবের গুলিতে পা হারানো ঝালকাঠির কলেজছাত্র লিমনের ঘটনায় সংস্থাটি জোরারো ভূমিকা নিয়েছিল। এ ছাড়া বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম ছাড়া ছোটখাটো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় কমিশনকে ভূমিকা নেওয়ার নজির রয়েছে।

মানবাধিকার কমিশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ করে অসংখ্য মানুষ প্রতিকার পেয়েছেন। তা ছাড়া কমিশন থাকলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর বিষয়ে সরকারকে সজাগ করতে চিঠি লেখা হতো, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দিতে পারত। তারা কমিশনের আইনি ক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়েও গুরুত্বারোপ করেন।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) গত ৬ মাসের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জানুয়ারি থেকে জুনে কমপক্ষে ৫২৯টি ‘রাজনৈতিক সহিংসতার’ ঘটনায় অন্তত ৭৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৪ হাজার ১২৪ জন। এ সময়ে ১৫২টি হামলার ঘটনায় ২৫৭ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। কমপক্ষে ১৪১টি গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হন অন্তত ৬৭ জন এবং আহত হন অন্তত ১১৯ জন। এ ছাড়া ১১২টি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হন ৫৯ জন এবং আহত হন কমপক্ষে ৭২০ জন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত ছয় মাসে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ৪০টি হামলার ঘটনায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে ১৪ জন বাংলাদেশি নিহত ও ২০ জন আহত হয়েছেন এবং গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৭ বাংলাদেশি। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে কমপক্ষে ২ হাজার ৩৩৮ জনকে বাংলাদেশে পুশইন করেছে বিএসএফ। গত ছয় মাসে কমপক্ষে ১ হাজার ৪২ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হন কমপক্ষে ৪৭৬ জন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে, হেফাজতে ও নির্যাতনে কমপক্ষে ১৪ জন নিহত হয়েছেন।