দুর্নীতির অর্থে দুবাইয়ে আলিশান অফিস

মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, চট্টগ্রাম
০৮ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
দুর্নীতির অর্থে দুবাইয়ে আলিশান অফিস

চট্টগ্রাম বন্দরের যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ কাজের মাধ্যমে ২০০৫ সালে সাইফ পাওয়ারটেক যাত্রা শুরু করেছিল। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দলটির শীর্ষনেতাদের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটি বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংসহ নানা খাতে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। সরকারের উচ্চমহলের সিদ্ধান্তে বন্দর কর্তৃপক্ষ টেন্ডার ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বছরের পর বছর চুক্তি নবায়ন করেছে। আবার কখনও টেন্ডার হলেও নীতিমালায় এমন সব শর্ত জুড়ে দেওয়া হতো, যাতে সাইফ পাওয়ারটেক ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারে।

তবে সাইফ পাওয়ারটেকের তরফদার রুহুল আমিনের সেই ‘পাওয়ার’ আর থাকছে না। সরে দাঁড়াতে হয়েছে সাইফ পাওয়ারটেকের সেই আলাদীনের চেরাগ নামের বন্দরের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনা থেকে। যেই বন্দর পরিচালনার অর্থ পাচার করেছেন বিদেশে। এ ছাড়া দুবাইয়ে গড়ে তুলেছেন আলিশান অফিস। 

অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তে এনসিটি সাইফ পাওয়ারটেকের হাত থেকে মুক্ত হলেও চিটাগং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) পরিচালনার ভার মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখনও তাদের হাতেই থাকছে বলে জানা গেছে। 

ড্রাইডক পেল এনসিটি পরিচালনার ভার : এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেড। এটি নৌবাহিনী পরিচালিত একটি সামরিক জাহাজ মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান। গতকাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি টার্মিনাল পরিচালনা শুরু করেছে। গত রবিবার সাইফ পাওয়ারটেকের সঙ্গে বন্দরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনায় সাইফ পাওয়ারটেকের সঙ্গে আর চুক্তি করছে না বন্দর কর্তৃপক্ষ। 

এনসিটি থেকে সাইফ পাওয়ারটেককে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি আগেই চূড়ান্ত হয়েছিল। প্রথমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেই টার্মিনালটি পরিচালনা করবে। পরে সরকার নৌবাহিনীকে পরিচালনার দায়িত্ব দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে। তবে আইনি জটিলতা থাকায় সরাসরি নৌবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া সম্ভব হয়নি। দায়িত্ব পেয়েছে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান ড্রাইডক। 

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক আমাদের সময়কে বলেন, ড্রাইডকের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি বন্দর কর্তৃপক্ষের বোর্ড সভায় অনুমোদন হয়েছে। গতকাল থেকে ছয় মাসের জন্য চুক্তি হয়। এদিন সাইফ পাওয়ারটেক আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব হস্তান্তর করে।

সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন আমাদের সময়কে বলেন, রবিবার রাত ১২টায় আমরা দায়িত্ব হস্তান্তর করেছি। এর পর থেকে ড্রাইডকের অধীনেই পরিচালিত হচ্ছে; তবে আমরা এখনও সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছি। 

এর আগে এনসিটি বিদেশিদের হাতে না দেওয়ার দাবিতে বিভিন্ন পক্ষ সরব হয়। সাইফ পাওয়ারটেককে রক্ষা করতেই মূলত ওই দাবি তোলা হয় বলে অভিযোগ অনেকের। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে বন্দর দেওয়ার প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপি-জামায়াত। শ্রমিক সংগঠনগুলো নিয়মিত নানা কর্মসূচি পালন করেছে। ‘সাম্রাজবাদবিরোধী দেশপ্রেমিক জনগণ’ নামে বামপন্থিদের একটি প্ল্যাটফর্ম ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে গত ২৭ ও ২৮ জুন দুই দিনের রোডমার্চ কর্মসূচি পালন করে। এ ছাড়া শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্যপরিষদ (স্কপ) গত ৩০ জুন চট্টগ্রাম বন্দর গেটে শ্রমিক সমাবেশ করে। আন্দোলনের ডামাডোলের মধ্যেই নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন একটি হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট ফাঁস করেন। এতে টাকা ঢেলে বন্দর অচলের জন্য সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন নির্দেশনা দেন বলে অভিযোগ করেন উপদেষ্টা সাখাওয়াত। এর পরও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও শ্রমিক সংগঠন আন্দোলন চলমান রাখে। এসবের মধ্যেই ড্রাইডককে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দিল সরকার। 

ড্রাইডকের মাধ্যমে এনসিটি পরিচালনাকে সরকারের কৌশল হিসেবে দেখছেন চট্টগ্রামের সংগঠক ও জেলা সিপিবির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নুরুচ্ছাফা ভূঁইয়া। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, সরকার কী উদ্দেশ্যে ড্রাইডকের মাধ্যমে এনসিটি পরিচালনা করছে সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে। ডিপি ওয়ার্ল্ডকে এনসিটি দেবে না এটা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত আমরা এ বিষয়ে শঙ্কিত। ডিপি ওয়ার্ল্ডের এনসিটি পরিচালনার বিরোধিতা করেই যাবেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর সক্ষম এবং লাভজনক প্রতিষ্ঠান। তা হলে আমরা কেন বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দিতে যাব? এ ছাড়া এনসিটিতে বিনিয়োগের তো সুযোগই নেই। জেটি আছে, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে, দক্ষ কর্মীও আছে। তা হলে কোন যুক্তিতে আমরা বিদেশিদের দেব? 

বাম জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স আমাদের সময়কে বলেন, ‘ড্রাইডকের মাধ্যমে এনসিটি পরিচালনায় আমরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ এবং মর্মাহত। আমরা মনে করেছিলাম দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্তভাবে বন্দর কর্তৃপক্ষ সেটি পরিচালনা করবে। কিন্তু সরকার গণস্বার্থ বিরোধী কাজে এখনও লিপ্ত রয়েছে।’ ক্ষোভের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘নৌপরিবহন উপদেষ্টা বলেছেন ছয় মাস পর বিদেশি কোম্পানিকেই দেওয়া হবে। তাই দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ অব্যাহত থাকলে আগামী ৫ আগস্টের পর আমরা কঠোর আন্দোলনে যাব।’

বন্দরের টাকায় দুবাইতে শিপিং কোম্পানি : জানা গেছে, তরফদার মো. রুহুল আমিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, বন্দর-পতেঙ্গা আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এমএ লতিফ, নূর-ই-আলম চৌধুরী, হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এবং চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনসহ দলটির শীর্ষনেতাদের। এই ঘনিষ্ঠতা এবং ব্যবসার ভাগ দিয়েই পুরো বন্দরকে কব্জায় নিয়েছিলেন তরফদার। ফলে বন্দর ছাড়াও দেশের আরও অনেক বড় সরকারি প্রকল্পে প্রবেশাধিকার পান তিনি। 

সাইফ পাওয়ারটেকের বিরুদ্ধে ২০২২ সালে দুবাইভিত্তিক সাফিন ফিডার কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতার ঘোষণা দিয়ে শেয়ারবাজারে শেয়ারদর বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতে খোলা প্রতিষ্ঠান সাইফ মেরিটাইম এলএলসির অর্থ বাংলাদেশ থেকে কীভাবে পাচার হয়েছে, তা নিয়ে তদন্ত চলছে বলে জানা গেছে। দুদক, এনবিআরসহ বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা সাইফ পাওয়ারটেকের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার, রাজস্ব ফাঁকি ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সরকারি কাজ বাগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত চট্টগ্রাম বন্দরের টাকা দুবাইতে পাচার করেছেন সরকারি সহায়তা নিয়ে। সেই টাকায় দুবাইতে আলিশান অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছেন।  

সচেতন নাগরিক সমাজ (সনাক) চট্টগ্রামের সভাপতি আখতার কবির চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, দেশে একশ্রেণির ব্যবসায়ী টাকা পাচার করে থাকে। এ জন্য দেশের কিছু সিস্টেম দায়ী। যারা টাকা পাচার করে তাদের প্রতি নজরদারি বাড়াতে হবে। দায়িত্ববোধও বাড়াতে হবে।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে মোট চারটি কনটেইনার টার্মিনাল আছে- চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি), নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), জেনারেল কার্গো বার্থ (কনটেইনার ও বাল্ক-জিসিবি) এবং পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি)। এনসিটি চট্টগ্রাম বন্দরে প্রথম নির্মিত ও সবচেয়ে বড় টার্মিনাল, যাতে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য কি গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ আরও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে হ্যান্ডলিং হওয়া ৩২ লাখ টিইইউস কনটেইনারের মধ্যে ৪৪ শতাংশ এককভাবে হ্যান্ডলিং হয়েছে এনসিটিতে। 

২০০৭ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ এক হাজার মিটার দৈর্ঘ্যরে এনসিটি টার্মিনালটি নির্মাণ করে। এরপর বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেরাই প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করে। শুরু থেকেই বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীদের দাবি ছিল, এনসিটি বন্দরের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা করার। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর এনসিটি পরিচালনার ভার তুলে দেয় বেসরকারি সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের হাতে।

সূত্র জানায়, ১৫ বছর ধরে দফায় দফায় চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর পর সাইফ পাওয়ারটেকের সময় শেষ হয় গত ৬ জুলাই। এ অবস্থায় গত ১৮ জুন এনসিটি পরিচালনার বিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে উচ্চপর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সাইফ পাওয়ারটেকের চুক্তির মেয়াদ আর না বাড়িয়ে আপাতত ছয় মাস বন্দরের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এনসিটি পরিচালনার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়।

কর্ণফুলী ড্রেজিংও গিলেছিল সাইফ : চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ চলাচলের বিষয়টি সুগম রাখতে কর্ণফুলী নদীর সদরঘাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত ড্রেজিংয়ের বিকল্প নেই। বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠান ড্রেজিংয়ের কাজ পেয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ লোপাট করে পালিয়ে যাওয়ার পর আইনগত কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়। সেটি সমাধানের পর একটি সংস্থাকে ড্রেজিংয়ের কাজ দেওয়া হয়। সে সংস্থা থেকে কাজটি সাব-কন্ট্রাক্টে নিয়ে সাইফপাওয়ার আরও চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে আন্ডারহ্যান্ড লাভে বিক্রি করে দেয়। ফলে এ বন্দরের ড্রেজিংয়ের কাজে রীতিমতো বারোটা বেজেছে। উজান থেকে আসা পলিতে কর্ণফুলী নদী ক্রমাগতভাবে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বন্দরের সিসিটি ও এনসিটি ইয়ার্ড থেকে কয়েকশ কনটেইনার গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। চট্টগ্রাম কাস্টম কর্তৃপক্ষ এসব কনটেইনারের অস্তিত্ব বের করে দেওয়ার জন্য সাইফ পাওয়ারটেককে একাধিক চিঠি দিয়েও সমাধান পায়নি। 

সাইফ পাওয়ারটেকের পেছনে আ.লীগ নেতারা : সাইফ পাওয়ারটেকের হাতে যে ছয়টি জেটি রয়েছে, সেগুলোর মাধ্যমেই বন্দরের ৬৫ শতাংশ কনটেইনার উঠানো-নামানো হয়। ২০০৬ সালে বন্দরে কাজ শুরু করা সাইফ পাওয়ারটেক আওয়ামী লীগ আমলেই সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছে। 

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, সংসদীয় কমিটি ও বন্দর কর্মকর্তারা কীভাবে সাইফ পাওয়ারটেককে বন্দরের কাজ পেতে সহযোগিতা করতেন, তার বড় উদাহরণ নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনাসংক্রান্ত টেন্ডার। বাংলাদেশে প্রথম বন্দরকেন্দ্রিক বিদেশি বিনিয়োগ হওয়ার কথা ছিল এই নিউমুরিং টার্মিনালে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সে কাজ গুছিয়ে এনেছিল। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নূর-ই-আলম চৌধুরী ও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের হস্তক্ষেপে দরপত্র প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়। টার্মিনালটি চালু করতে লেগে যায়় বছর। ২০১৫ সালে টার্মিনালটির চার জেটিকে দুই প্যাকেজে ভাগ করে দরপত্র আহ্বান করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। দরপত্রের শর্ত এমনভাবে দেওয়া হয়েছিল, যাতে সাইফ পাওয়ারটেক ছাড়া আর কেউ যোগ্য নির্বাচিত না হয়।