জাল মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরি, বহিষ্কারের পর জালিয়াতিই তার পেশা

রহমান জাহিদ
০৬ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
জাল মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরি, বহিষ্কারের পর জালিয়াতিই তার পেশা

ফেনী সদর উপজেলার দক্ষিণ চোছনা এলাকার মো. সফিকুর রহমানের ছেলে শহীদুল ইসলাম সবুজ (৩৯)। ২০০৮ সালে মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে স্টেনো-টাইপিস্ট পদে চাকরি পান। আট বছর চাকরি করার পর মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির অভিযোগে ২০১৬ সালে তার চাকরি চলে যায়। তখন ডিবির হাতে তিনি গ্রেপ্তারও হন। গ্রেপ্তারের সময় তার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ জাল মুক্তিযোদ্ধা সনদ এবং সনদ জাল করার সামগ্রী জব্দ করা হয়। ওই ঘটনায় শাহআলী থানায় মামলা হয়। ওই মামলায় জামিনে মুক্তির পর জালিয়াতি ও প্রতারণাকেই নিজের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন তিনি। সম্প্রতি আবারও প্রতারণার মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান শহীদুল ইসলাম সবুজ।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, স্থায়ীভাবে জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণা চালিয়ে নিতে রাজধানীর দারুস সালাম থানা এলাকার মুক্তবাংলা মার্কেটের ষষ্ঠ তলায় ৮৮ নম্বর রুম ভাড়া নেন শহীদুল ইসলাম সবুজ। সেখানে জাল দলিল তৈরির সময় গত বছর ১৩ মে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে তিনি দাবি করেন, একটি জালিয়াত চক্রের সদস্য তিনি। চক্রটির মূল হোতা জয়নাল আবেদীন ইদ্রিস নামে এক ব্যক্তি এবং তার প্রধান সহযোগী সাইদুর রহমান। চক্রটি কোনা ফ্ল্যাট বা জমির একাধিক দলিল তৈরি করে থাকে। পরে বিভিন্ন ব্যাংকের স্টেটমেন্ট নকল করে নকল সিলমোহর দিয়ে নিজেরা স্বাক্ষর করে। চক্রটির সদস্য সৈয়দ তারেক আলীসহ আরও অজ্ঞাতনামা সাত-আটজন ব্যক্তি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লোন উত্তোলনের জন্য এই জাল কাগজপত্র তৈরি করে। এ জাল কাগজপত্র দিয়ে তারা বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লোনের আবেদন করে। একপর্যায়ে লোন পাশ হলে লোনের টাকা উত্তোলন করে নিজেরা ভাগবাটোয়ারা করে নেয়।

জানা গেছে, চক্রটির সদস্যদের এই কাজে সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ আরও সাত-আটজন ব্যক্তি জড়িত রয়েছে। তারা এভাবে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লোন উত্তোলন করে ৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এ নিয়ে রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানায় ২০২৩ সালের ৪ ডিসেম্বর সিআইডি পুলিশ মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে একটি মামলা করে। এ মামলায় এজাহারে ২৫ আসামি রয়েছে। মামলাটিতে ১৭ নম্বর আসামি সবুজ। গত বছর ১৩ মে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় এবং একদিনের রিমান্ডও মঞ্জুর করেন আদালত।

রিমান্ড শেষে সবুজ গত বছর ২১ জুন আদালতে একটি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন। তাতে তিনি নিজের বাবার প্রকৃত নাম বলেননি। জবানবন্দিতে এই মামলায় তার নাম ঠিক থাকলেও বাবার নাম মো. সোবহান এবং তিনি গোমতি এন্টারপ্রাইজের মালিক বলে দাবি করেন। তবে সিআইডি জানতে পারে, সবুজের বাবার নাম সফিকুর রহমান। প্রতারণার উদ্দেশ্যে বাবার নাম মো. সোবহান উল্লেখ করে এনআইডি তৈরি করেছেন।

জানা গেছে, শহীদুল ইসলাম সবুজ মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির অভিযোগে চাকরি চলে যাওয়ার পর তিনি পুরোপুরিভাবে প্রতারণা ও জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়েন। এর মধ্যে চেক ডিজঅনারের একটি মামলায় তিনি এক বছর সাজা ভোগ করেছেন। তার বিরুদ্ধে আরও একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে।

উত্তরা পূর্ব থানায় মামলাটির এজাহারে বলা হয়, ২০২২ সালের ৩০ আগস্ট বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর আওতায় তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ প্রসঙ্গে একটি প্রতিবেদন পাঠায়। এটি পার্যালোচনায় দেখা যায় যে, নীড় এস্টেট প্রোপার্টিজ লিমিটেডের নামে মেঘনা ব্যাংকের উত্তরা শাখায় ২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি একটি চলতি হিসাবে খোলা হয়। পরবর্তী সময়ে আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেড কর্তৃক একই বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি ইস্যুকৃত ৫০ লক্ষ টাকা মূল্যমানের ঢাকা ব্যাংক লিমিটেডের চেক ক্রিয়ারিংয়ের মাধ্যমে আসা অর্থ হিসাবটিতে জমা করা হয়। আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেড হতে তারেক আজিজকে প্রদত্ত গৃহ ঋণের বিপরীতে ফ্ল্যাট ক্রয়ের নিমিত্তে নিড় এস্টেট প্রোপার্টিজ লিমিটেডের অনুকূলে ৫০ লাখ টাকার বর্ণিত চেকটি ইস্যু করা হয়েছে মর্মে পরিলক্ষিত হয়। ব্যাংক কর্তৃক হিসাবটির দলিলাদি বিশ্লেষণে সন্দেহ হওয়ায় রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসে (আরজেএসসি) মালিকানার তথ্য যাচাইয়ের জন্য আবেদন করা হয়। জবাবে আরজেএসসি জানায়, প্রতিষ্ঠানটির নাম সঠিক নয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এটি একটি ভয়াবহ সংঘবদ্ধ প্রতারণা ও জালিয়াতি চক্র, যারা দীর্ঘ দিন ধরে এ ধরেনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। এই চক্রের সদস্যরা পরস্পর যোগসাজশে ভুয়া দলিল/কাগজপত্র (টিন সার্টিফিকেট, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও ফ্ল্যাটের কাগজপত্রসহ অন্যান্য দলিলাদি ও কাগজপত্র) তৈরি করে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হয়েছে।