অকটেন ­সংকটের নেপথ্যে দেশীয় উৎপাদন হ্রাস

লুৎফর রহমান কাকন
০২ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
অকটেন ­সংকটের নেপথ্যে দেশীয় উৎপাদন হ্রাস

দেশে অকটেনের যে চাহিদা, তার প্রায় অধিকাংশই উৎপাদন সক্ষম দেশের সরকারি-বেসরকারি রিফাইনারিগুলো। কিছুটা আমদানি করতে হয়। তবে সরকারি এবং বেসরকারি রিফাইনারিগুলো সংস্কারের অভাব, জরাজীর্ণতা বা প্ল্যান্ট রক্ষণাবেক্ষণ, ডলার সংকট বা এলসি জটিলতার কারণে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি করতে পারেনি। ফলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসোলিন-৯৫ বা অকটেন উৎপাদন করতে পারছে না রিফাইনারিগুলো। ফলে বিদেশ থেকে পরিশোধিত-অপরিশোধিত জ¦ালানি তেলের সঙ্গে এখন অকটেন আমদানিও বাড়াতে হচ্ছে সরকারকে।

বিপিসি সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর দেশের একমাত্র অপরিশোধিত তেল পরিশোধনাগার সরকারের ইস্টার্ন রিফাইনারি ও বেসরকারি পেট্রোকেমিক্যাল রিফাইনারিগুলো (প্ল্যান্ট) থেকে চাহিদার তুলনায় প্রায় ৭৫ হাজার টন অকটেন কম সরবরাহ করা হয়েছে। ফলে দেশের অভ্যন্তরে যে চাহিদা রয়েছে, সেটা মেটাতে চলতি বছর অকটেন আমদানি বাড়াতে হয়েছে সরকারকে। এ অবস্থায় সরকার আপৎকালীন চাহিদাসহ মোট ছয় লাখ ৫০ হাজার টন গ্যাসোলিন ৯৫ আনলেডেড (অকটেন) এর চাহিদা প্রাক্কলন করেছে।

বিষয়টি নিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, দেশে প্রতিদিন গড়ে ১১শ টনের বেশি অকটেনের চাহিদা রয়েছে। পেট্রলের চাহিদাও প্রায় সমান। যার অধিকাংশই দেশে উৎপাদন করা সম্ভব। তবে চলতি বছর দেশীয় ও সরকারি রিফাইনারিগুলো চাহিদা অনুযায়ী অকটেন উৎপাদন ও সরবরাহ করতে না পারার কারণে সরকার বেশি করে আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এই কর্মকর্তা বলেন, দেশে অকটেনের কিছুটা ঘাটতি আছে। এ ছাড়া ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ পরিস্থিতিকে বিবেচনা করে কিছু অসৎ ব্যবসায়ী কয়েক দিন ধরে অকটেন স্টক করার চেষ্টা করেছিল। দাম বাড়তে পারে এ অনুমান থেকে তারা এটা করেছে। এ ছাড়া অনেক পেট্রলপাম্প মালিক অতিরিক্ত অকটেনের চাহিদাপত্র দিচ্ছিল ডিপোগুলোতে। ফলে আমরা দ্রুত জুলাই মাসের দাম জুনের সঙ্গে অপরিবর্তিত রেখে নতুন দাম ঘোষণা করেছি।

সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) পিপিআর-২০০৮ অনুযায়ী সরাসরি বা জি-টু-জি ভিত্তিতে জ্বালানি তেল আমদানি করে থাকে। এ লক্ষ্যে প্রতিবছরের জন্য অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি অনুমোদন গ্রহণ করে থাকে। সরকারের অনুমোদনসাপেক্ষে জানুয়ারি-জুন ও জুলাই-ডিসেম্বর দুই মেয়াদে জন্য বিপিপি তেল আমদানি করে।

বিপিসি সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সিলেট গ্যাসফিল্ড রিফাইনারি থেকে ৩২ হাজার ৮১৬ টন অকটেন সরবরাহের প্রতিশ্রুতি থাকলেও বিপিসিকে করেছে ২৬ হাজার টন। সুপার পেট্রোকেমিক্যাল এক লাখ ছয় হাজার টনের জায়গায় সরবরাহ করেছে ৬৮ হাজার টন, পেট্রোম্যাক্স রিফাইনারি প্রতিশ্রুত ৩৬ হাজার ৪৮০ টনের জায়গায় সরবরাহ করেছে ১৯ হাজার ৮৯০ টন, এ্যাকোয়া রিফাইনারি থেকে ১৮ হাজার টন সরবরাহের প্রতিশ্রুতির পরিবর্তে সরবরাহ করা হয়েছে চার হাজার ৫০০ টন, পারটেক্স পেট্রো লিমিটেড থেকে সরবরাহ করা হয়েছে ছয় হাজার ৯০০ টন, প্রতিশ্রুতি ছিল ৮০ হাজার ৩৬৫ টন। বিপিসি বলছে, প্রত্যাশিত অকটেন প্রাপ্তির চেয়ে প্রায় ৭৫ হাজার টন কম পাওয়া গেছে। ফলে বিপিসিকে চলতি বছর পরিকল্পনার চেয়ে অতিরিক্ত আরও ৫০ হাজার টন অতিরিক্ত অকটেন আমদানি করতে হয়েছে।

জ¦ালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আপৎকালীন চাহিদাসহ মোট ছয় লাখ ৫০ হাজার টন গ্যাসোলিন ৯৫ আনলেডেডের (অকটেন) চাহিদা প্রাক্কলন করা হয়েছে। উক্ত চাহিদার মধ্যে এক লাখ ২৫ হাজার টন জি-টু-জি ভিত্তিতে; এক লাখ ২৫ হাজার টন আন্তর্জাতিক দরপত্র (কোটেশন) পদ্ধতিতে এবং অবশিষ্ট চার লাখ টন স্থানীয় ৫টি সরকারি-বেসরকারি প্ল্যান্ট থেকে সংগ্রহের পরিকল্পনা করা হয়।

স্থানীয় প্ল্যান্টসমূহ চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে বিপিসির প্রত্যাশিত পরিমাণের চেয়ে প্রায় ৭৪ হাজার ৫৫৭ টন অকটেন কম সরবরাহ করছে। প্ল্যান্টগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায় যে, এলসি-সংক্রান্ত জটিলতা, প্ল্যান্টের রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণ কাঁচামাল (কনডেনসেট-ন্যাফথা) আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না বিধায় প্ল্যান্ট থেকে প্রতিশ্রুত পরিমাণ জ্বালানি তেল অর্থাৎ অকটেন সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। ফলে জানুয়ারি-জুন প্রান্তিকে দেশে অকটেনের রিজার্ভ কম থাকায় নতুন করে আমদানি বাড়াতে হয়।

এদিকে বিপিসির সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, এখন প্রতিনিয়ত জ¦ালানি তেলের চাহিদা বাড়ছে। ১০ বছর আগেও যেখানে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টন জ¦ালানি তেলের চাহিদা ছিল, এখন তা প্রায় ৭০ লাখ টন। কিন্তু গত এক যুগেও দেশে নতুন করে কোনো রিফাইনারি তৈরি করেনি সরকার। ইস্টার্ন রিফাইনারি দ্বিতীয় ইউনিট নিয়ে এক যুগ ধরে আলোচনা হলেও কার্যত কোনো উন্নতি নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এর ডিপিপি অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। সরকার অনুমোদন করলে কাজ শুরু হতে পারে।