বাণিজ্যিকভাবে চলতি মাসে শুরু হবে ডিজেল পরিবহন

চট্টগ্রাম-নারায়ণগঞ্জ তেল পাইপলাইন

লুৎফর রহমান কাকন
০১ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বাণিজ্যিকভাবে চলতি মাসে শুরু হবে ডিজেল পরিবহন

চট্টগ্রাম-নারায়ণগঞ্জ জ্বালানি তেল ডিজেল পাইপলাইন বাণিজ্যিক অপারেশনের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে। এরই মধ্যে পরীক্ষামূলক তেল পরিবহন সফলভাবে শেষ হয়েছে। চলতি জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে এই পাইপলাইন দিয়ে ডিজেল পরিবহন শুরু হবে। এতে দেশে প্রথমবারের মতো জ্বালানি তেল পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহে বছরে আড়াইশ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। প্রকল্পটির নাম ঢাকা-চট্টগ্রাম পাইপলাইন হলেও কার্যত এটি চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জের গোদনাই এবং গোদনাইল থেকে ফতুল্লা পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান গতকাল সোমবার আমাদের সময়কে বলেন, আশা করছি সপ্তাহ দুই-তিনেকের মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পাইপলাইন প্রকল্পটি আমাদের কাছে হস্তান্তর করবে। তার পরপরই আমরা বাণিজ্যিক অপারেশন শুরু করব। এরই মধ্যে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পাইপলাইনে পরীক্ষামূলকভাবে ৬ হাজার টন ডিজেল পরিবহন করা হয়েছে।

বিপিসির চেয়ারম্যান বলেন, পাইপলাইনটি বাণিজ্যিক অপারেশনে যাওয়ার পর চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় তেল পরিবহনের ক্ষেত্রে যে ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, তা আর হবে না। যেমন রেলওয়ের ওয়াগন থাকলেও লোকোমোটিভ পাওয়া যায় না। সড়কপথে পণ্য পরিবহনে যানজটসহ নানা সমস্যা হয়, দীর্ঘ সময় লাগে। জলপথেও সমস্যা হয়। অনেক সময় তেল খালাস বা আনলোড করার সময় চুরির অভিযোগ পাওয়া যায়। পাইপলাইনটি চালু হলে এসব সমস্যা শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। তিনি জানান, দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেল ৭০ শতাংশ। সেটা সরবরাহ নিশ্চিত হবে পাইপলাইনটি চালু হলে। পেট্রোল ও অকটেন আগে যেভাবে সরবরাহ করা হতো, কখনও রেলওয়ে ওয়াগনে করে, কখনও নদীপথে ট্যাঙ্কারে করে; সেভাবেই আসবে।

এদিকে, জ¦ালানি বিভাগ পেট্রোলিয়াম পণ্য পরিবহনের জন্য আলাদাভাবে পেট্রোলিয়াম ট্রান্সমিশন কোম্পানি পিএলসি (পিটিসি পিএলসি) নামে একটি আলাদা কোম্পানি গঠন করেছে। সেই কোম্পানি মূলত পাইপলাইনে তেল পরিবহনের বিষয়টি দেখভাল করবে।

পিটিসি পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রায়হান আহমাদ আমাদের সময়কে বলেন, পাইপলাইনে তেল পরিবহনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শিগগিরই শুরু হবে। দুই দফা পরীক্ষামূলক সরবরাহ করা হয়েছে। আরও কিছু কাজ আছে, সেগুলো চলছে।

বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ জুন থেকে পরবর্তী পাঁচ দিন সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এই পাইপলাইনের মাধ্যমে ডিজেল নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ডিপোতে পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষামূলক এই সরবরাহ শতভাগ সফল হয়েছে।

বিপিসি কর্মকর্তারা জানান, দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৯২ শতাংশ আমদানি করা হয়। বছরে দেশে জ্বালানি তেলের গড় চাহিদা ৬৫ লাখ টন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫৯ লাখ ১০ হাজার টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এর মধ্যে ৩০ লাখ ৮০ টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল জি-টু-জি চুক্তির আওতায় এবং ২৮ লাখ ৩০ হাজার টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আমদানি করা হয়। এর বাইরে ১৪ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিপিসি। পরিশোধিত জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেল, মোগ্যাস, জেট এ-১, ফার্নেস অয়েল এবং মেরিন ফুয়েল রয়েছে। পরিশোধিত তেলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয় ডিজেল। দেশের ডিজেলের চাহিদার ৪০ শতাংশ ব্যবহার হয় ঢাকায়। বর্তমানে ঢাকায় তেল পরিবহনের করতে প্রথমে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে নদীপথে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ও ফতুল্লা ডিপোতে নেওয়া হয়। সেখান থেকে সড়কপথে ঢাকায় পরিবহন করা হয়। পরিবহনে প্রতি মাসে প্রায় ১৫০টি ছোট-বড় জাহাজ ব্যবহৃত হয়। এতে বছরে ২০০ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাইপলাইনটি চালু হলে সড়ক ও জলপথে পরিবহনের জন্য কোনো টাকা ব্যয় হবে না। শুধু পরিচালন, রক্ষণাবেক্ষণ, বিদ্যুৎ বিল, জমির ভাড়াসহ কিছু খাতে ব্যয় হবে ৯০ কোটি টাকা। বছরে প্রকল্পটি থেকে আয় হবে ৩২৬ কোটি টাকা। সাশ্রয় হবে ২৫০ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যে টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে, তা আগামী ১৬ বছরের মধ্যে উঠে আসবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে একদিকে যেমন জ্বালানি তেল পরিবহন খরচ কমবে, অন্যদিকে নির্বিঘ্নে হবে সরবরাহব্যবস্থা। একই সঙ্গে পরিবেশ দূষণ কমবে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে নৌপথে নাব্য কমে যাওয়ায় তেল পরিবহন করার যে সংকট, তা-ও আর থাকবে না।

জানা গেছে, নদীপথে লাইটারেজে পরিবহনকে কেন্দ্র করে একটি বিশাল সিন্ডিকেট বিদ্যমান। গোদনাইল ডিপো তেল চুরির জন্য স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত। সেই চুরি জায়েজ করতে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হতো লাইটারেজ থেকে তেল খালাসের সময় অপচয় বলে। পাইপলাইন হয়ে গেলে সেই বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করে বিপিসি।

শুরুতে এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৮৬১ কোটি ৩১ লাখ টাকা। পরে সংশোধিত হয়ে বেড়ে ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকায়। এটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। সেনাবাহিনী ২৪ ব্রিগেড পাইপলাইন নির্মাণের কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করায় এখন নারায়ণগঞ্জ (গোদনাইল ডিপো) থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত জেট ফুয়েল পরিবহনে পাইপলাইন নির্মাণের কাজও তাদের দেওয়া হবে বলে বিপিসি সূত্রে জানা গেছে। বিপিসির অর্থায়নে গৃহীত ঢাকা-চট্টগ্রাম পাইপলাইনের দৈর্ঘ্য ২৩৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত ৫৯ কিলোমিটার। আর ফতুল্লা থেকে গোদনাইল ডিপো পর্যন্ত সাড়ে ৮ কিলোমিটার।