তেহরানে শোক মিছিল ও জানাজায় লাখো মানুষ
ইসরায়েলি হামলায় নিহত ইরানের সামরিক কর্মকর্তা ও বিজ্ঞানীদের জানাজায় অংশ নিতে তেহরানের ইঙ্গেলাব (বিপ্লব) স্কয়ারে হাজারো মানুষ জড়ো হন। গতকাল শনিবার কালো পোশাকে শোকার্ত মানুষ শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। এ দিন ৬০ জনের বেশি নিহতের জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়। বিশাল এই শোকসভায় উপস্থিত ছিলেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানসহ বাহরাইন, ইরাকসহ কয়েকটি আরব দেশের প্রতিনিধিরাও। শোক মিছিল থেকে স্লোগান ওঠে- ‘আমেরিকার ধ্বংস চাই’, ‘ইসরায়েলের ধ্বংস চাই’, ‘আমরা ভুলব না, ক্ষমাও করব না’, ‘খামেনি, আমরা তোমার সঙ্গে আছি।’ লেবাননের সংবাদমাধ্যম আল-মায়েদিন জানায়, শনিবার ভোর থেকেই তেহরানের রাস্তায় নেমে আসেন নারী-পুরুষ ও তরুণ-তরুণীরা। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে শহীদদের স্মরণে আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি শুরু হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। জানাজা ও শোক মিছিল শুরু হয় তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেখান থেকে শহীদদের জাতীয় পতাকায় মোড়ানো কফিনগুলো ট্রাকে করে ইঙ্গেলাব স্কয়ার থেকে আজাদি স্কয়ারে নিয়ে যাওয়া হয়। হাজারো মানুষ কফিনবাহী ট্রাকের সঙ্গে জাতীয় পতাকা ও শহীদদের ছবি নিয়ে মিছিলে হেঁটে শোক প্রদর্শন করেন। এই গণজানাজায় অংশ নিতে সবাইকে আহ্বান জানিয়ে দেশটির সরকার মেট্রো ও বাসের ভাড়া এক দিনের জন্য মওকুফ করে। এ ছাড়া বন্ধ রাখা হয় অফিস-আদালত। এ সময় অনেক অংশগ্রহণকারী আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) ও সংস্থার প্রধান রাফায়েল গ্রোসির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে তার বিচারের দাবি জানান।
ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) তেহরান শাখার কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান হাসানজাদে জানান, এই জানাজা ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস-৩’-এর অংশ। এটি ইরানের জাতীয় ঐক্য ও প্রতিরোধের প্রতীক। তিনি বলেন, ‘শহীদদের আত্মত্যাগ আমাদের জন্য প্রেরণার উৎস।’ ইরানের ইসলামি উন্নয়ন সমন্বয় পরিষদের প্রধান মোহসেন মাহমুদি বলেন, ‘ইসলামি ইরান ও বিপ্লবের ইতিহাসে আজকের দিনটি এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়।’
গণজানাজায় শ্রদ্ধা জানানো হয় ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরিকে, যিনি স্ত্রী ও মেয়েসহ নিহত হন। স্মরণ করা হয় পরমাণু বিজ্ঞানী মোহাম্মদ মেহদি তেহরানচি, তার স্ত্রী এবং যুদ্ধের প্রথম দিনেই নিহত আইআরজিসি প্রধান হোসেইন সালামিকে। শহীদদের তালিকায় ছিলেন ৩০ জন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও চারজন শিশু। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৬২৭ জন নিহত এবং ৪ হাজার ৮৭০ জন আহত হয়েছেন। নিহত শিশুদের ছোট ছোট কফিন শোক মিছিলে হৃদয়বিদারক দৃশ্য তৈরি করে। স্বজনদের কাঁপা হাতে বহন করা সেই কফিনগুলো স্পর্শ করে যেন পুরো জাতি ভাগ করে নেয় তাদের বেদনা।
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শনিবার তার মালিকানাধীন সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় বক্তব্য দেন। ইসরায়েলের সঙ্গে টানা ১২ দিনের যুদ্ধে ইরান জয় পেয়েছেÑ খামেনির এমন দাবির তীব্র সমালোচনা করে শুক্রবার ডোনাল্ড ট্রাম্প লেখেন, ‘আগের দিন এক বক্তব্যে ইরানের বিজয় দাবি করার সময় খামেনি নির্লজ্জ ও বোকামিপূর্ণ মিথ্যা বলেছেন।’ এ ছাড়া তিনি হুমকি দিয়ে বলেছেন, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করলে তার দেশ ইরানে আবার বোমাবর্ষণ করবে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
গত শনিবারের আরেকটি পোস্টে খামেনির অকৃতজ্ঞতার অভিযোগ এনে ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে ‘এক ভয়ংকর ও অপমানজনক মৃত্যু’ থেকে রক্ষা করেছিলেন। তার অবস্থান জানলেও আঘাত করেননি। এ জন্য তাকে বলতে হবে না যে মি. প্রেসিডেন্ট আপনাকে ধন্যবাদ? ট্রাম্প আরও বলেন, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে তিনি ইরানের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে কাজ করছেন, যা তেহরানের অন্যতম প্রধান দাবি। ট্রাম্প ইরানকে আলোচনার টেবিলে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে আরও বলেন, ‘কিন্তু না, বরং আমি রাগ, ঘৃণা এবং ঘৃণার একটি বিবৃতিতে আঘাত পেয়েছি এবং অবিলম্বে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং আরও অনেক কিছুর জন্য সমস্ত কাজ বন্ধ করে দিয়েছি।’ ট্রাম্প বলেছেন, আগামী সপ্তাহে আবার আলোচনা শুরু হবে।
ট্রাম্পের এই মন্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি। তিনি এক্সে লেখেন, ‘যদি ট্রাম্প সত্যিই সমঝোতা চান, তবে তাকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার প্রতি অসম্মানজনক ভাষা বন্ধ করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ব দেখেছে ইসরায়েলি শাসকরা কীভাবে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের ভয়ে আমেরিকার শরণাপন্ন হয়েছে। আমাদের জাতি হুমকি কিংবা অপমান বরদাশত করে না।’
প্রসঙ্গত, গত ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানের সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনায় ভয়াবহ হামলা চালায়। গত সপ্তাহের শুরুতে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এর আগে ইরানের ফর্দো, নাতানজ ও ইস্পাহান পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। এর জবাবে কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে পাল্টা হামলা চালিয়ে তেহরান মূলত ওয়াশিংটনের গালে ‘সজোরে চড়’ মেরেছে- ১২ দিনের সংঘাত বন্ধের পর দেওয়া প্রথম ভিডিও বার্তায় এমন কথা বলেন খামেনি।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে ডেমোক্র্যাটদের আনা একটি প্রস্তাব খারিজ হয়ে গেছে, যেখানে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর আগে কংগ্রেসের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছিল। স্থানীয় সময় শুক্রবার ভোটাভুটিতে প্রস্তাবটি ৫৩-৪৭ ভোটে নাকচ হয়। তবে প্রস্তাবটি খারিজ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেই ট্রাম্প জানান, তেহরান যদি উদ্বেগজনক হারে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা অব্যাহত রাখে, তাহলে তিনি আবারও বোমা হামলার কথা বিবেচনা করবেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, ভোটে দলীয় অবস্থান স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। তবে কিছু ব্যতিক্রমও দেখা যায়- পেনসিলভানিয়ার ডেমোক্র্যাট সিনেটর জন ফেটারম্যান রিপাবলিকানদের সঙ্গে মিলে প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেন। আবার কেন্টাকির রিপাবলিকান সিনেটর র?্যান্ড পল ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে মিলিত হয়ে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন।
প্রস্তাবটির মূল উদ্যোক্তা ছিলেন ডেমোক্র্যাট সিনেটর টিম কেইন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ ঘোষণার ক্ষমতা কংগ্রেসের হাতে ফিরিয়ে আনার পক্ষে সোচ্চার। ভোটের আগে দেওয়া বক্তব্যে কেইন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী কেবল কংগ্রেসেরই যুদ্ধ ঘোষণা করার ক্ষমতা রয়েছে। ইরানের বিরুদ্ধে যেকোনো শত্রুতা বা সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্যও কংগ্রেসের স্পষ্ট অনুমোদন প্রয়োজন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনি যুদ্ধ চান বা না চান, কিন্তু যদি বিশ্বাস করেন প্রেসিডেন্টের কংগ্রেসের অনুমতি নেওয়া উচিত। তবে আপনাকে সিনেট জয়েন্ট রেজল্যুশন ৫৯-এর পক্ষে ভোট দিতে হবে। এটাই আমাদের সংবিধান অনুযায়ী সঠিক পথ।’
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
যুক্তরাষ্ট্রের আইনে যুদ্ধের ক্ষমতা-সংক্রান্ত প্রস্তাব ‘প্রিভিলেজড’ হিসেবে গণ্য হওয়ায়, এটি সিনেটে দ্রুত ভোটের জন্য উত্থাপন করতে হয়। চলতি মাসেই টিম কেইন প্রস্তাবটি আনেন। তবে এটি কার্যকর করতে হলে কেবল সিনেট নয়, প্রতিনিধি পরিষদেও পাস করাতে হতো। কিন্তু প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার মাইক জনসন, যিনি ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র, সাফ জানিয়ে দেন যে, ‘এখন এমন উদ্যোগ নেওয়ার সময় নয়।’ উল্লেখ্য, ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ২০২০ সালে টিম কেইন একই ধরনের একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন, যা কংগ্রেসে পাসও হয়। সেই সময় কিছু রিপাবলিকানও প্রস্তাবটির পক্ষে ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পের ভেটো আটকানোর মতো প্রয়োজনীয় ভোট সংখ্যা পাওয়া যায়নি।