ঋণ শোধের চাপের সঙ্গে বাড়ছে রাজস্ব ঘাটতি
গত বছরের ৮ আগস্ট থেকে আর্থিক খাতে প্রচণ্ড চাপ আর লণ্ডভণ্ড অবস্থার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর বছর শেষ হয়ে গেলেও সামষ্টিক অর্থনীতির চাপ কমেনি। শুধু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকানো ছাড়া অন্য কোনো সূচকের উন্নতি করা সম্ভব হয়নি। এমনিতেই রাজস্ব আহরণে পিছিয়ে দেশ, কর-জিডিপি অনুপাতে বিশে^র সর্বনিম্নে থাকা দেশগুলোর একটি। আবার আগামী অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির সুযোগও সীমিত। তার ওপর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে চলছে অচলাবস্থা, যা রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমকে আরও পিছিয়ে দিচ্ছে। যখন মেয়াদপূর্তি ও গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে আসার কারণে সরকারের ওপর বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে, তখন পাল্লা দিয়ে রাজস্ব ঘাটতি বৃদ্ধি অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ তৈরি হচ্ছে। এই চাপ নিয়েই আগামী মঙ্গলবার ১ জুলাই থেকে শুরু হচ্ছে নতুন ২০২৫-২৬ অর্থবছর।
ইতোমধ্যে বিদায়ী অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিশাল রাজস্ব ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় এনবিআরকে বিলুপ্ত করে নতুন দুটি বিভাগ চালুর প্রতিবাদে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের চলমান আন্দোলন এখন তুঙ্গে। কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এনবিআর সম্পর্কিত সব কাজকর্ম কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বন্ধ রয়েছে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমও। ফলে শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরও সঙ্গী হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনৈতিক চাপ।
জানা গেছে, নতুন অর্থবছরে দেশি-বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বাড়বে। পরিকল্পনা অনুযায়ী করের আওতা না বাড়ায আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরেও সরকারের আয় বাড়ার সুযোগ সীমিত। ব্যবসা-বিনিয়োগে অব্যাহত ভাটা। এর সঙ্গে বাড়ছে দেশি-বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ। ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা। লাগামহীন সুদের হারে ব্যবসা-উদ্যোগে স্থবিরতা চলছে। পতনের ধারা থেকে বের হতে পারছে না দেশের প্রধান পুঁজিবাজার। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও উন্নতি ঘটেনি গত ১০ মাসে। এর মধ্যেই চলছে এবিআর কর্মীদের টানা কর্মবিরতি। এত সব বাধার মুখে বড় ধরনের রাজস্ব ঘাটতির মুখে সরকার। নতুন অর্থবছরেও তা অব্যাহত থাকবে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
অন্যদিকে বাজেট সহায়তা ও প্রকল্পের নামে ঢালাওভাবে নেওয়া বিদেশি ঋণ এখন সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে বাড়ছে সুদের হার, অন্যদিকে আসল পরিশোধের কিস্তির পরিমাণ বাড়ছে বছর বছর। সবচেয়ে বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে ডলার রেট। টাকার মান কমে যাওয়ায় বিদেশি ঋণ পরিশোধে সরকারকে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, কেবল রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে গৃহীত রাশিয়ান ঋণ পরিশোধ করলে চুক্তির সময়ের চেয়ে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা বেশি দিতে হবে। ডলার রেট বাড়লে ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শুধু সরকারের নেওয়া বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা জিডিপির ১৬ দশমিক ১৯ শতাংশ। ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া নতুন অর্থবছর শেষে এই ঋণের স্থিতি বেড়ে প্রায় ৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়াবে, অর্থাৎ জিডিপির ১৬ দশমিক ২৬ শতাংশে উঠে যাবে। এই স্থিতি থেকে গত অর্থবছরে সরকারকে আসল পরিশোধে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি পরিশোধ করতে হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুন শেষে পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২৫-২৬ অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের আসলের কিস্তি পরিশোধে সরকারকে ব্যয় করতে হবে প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। নতুন করে আর কোনো ঋণ না নিলেও শুধু ডলার রেট বেড়ে যাওয়ায় বিদেশি ঋণ বাবদ কিস্তি পরিশোধ বেড়ে যাবে।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
জানা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে যে পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলোর গ্রেস পিরিয়ড শেষে আসল ও সুদ একযোগে পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে বছর বছর ঋণের কিস্তি বাড়ছে, যা সরকারের আর্থিক খাতে ঝুঁকি তৈরি করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চার বছর আগেও যেখানে ১ ডলার ঋণ পরিশোধে স্থানীয় মুদ্রায় ৮০ থেকে ৮৫ টাকা ব্যয় হতো, এখন সেখানে ১২২ থেকে ১২৫ টাকা ব্যয় হচ্ছে। এটি সরকারের আর্থিক সক্ষমতায় বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে।
বাজেটের সঙ্গে দেওয়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে বিদেশি ঋণের ঝুঁকির বিষয়টি তুলে ধরে বলা হয়েছে, মেয়াদপূর্তি, গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়া এবং টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আগামী বছরগুলোতে ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বাড়বে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার অবমূল্যায়নের ফলে টাকার অঙ্কে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাচ্ছে। কারণ একই পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে এখন আরও বেশি টাকার প্রয়োজন হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা বর্তমান তারল্য সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য ঋণ পরিশোধের কার্যকর ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম