১১০ ভারতীয় নাগরিককে পুশইন করেছে বিএসএফ

শাহজাহান আকন্দ শুভ
২৫ জুন ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
১১০ ভারতীয় নাগরিককে পুশইন করেছে বিএসএফ

দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ কর্তৃক পুশইন থামছেই না। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে মানুষ ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবারও বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও লালমনিরহাট সীমান্ত দিয়ে ৪৬ জনকে পুশইন করেছে বিএসএফ। বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো মানুষের তালিকায় ভারতীয় নাগরিকও রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাও।

পুশইন করা মানুষের তালিকায় ১১০ জনকে ভারতীয় হিসেবে শনাক্ত করেছে বিজিবি। তাদের মধ্যে ১০৬ জনকে ভারতে পুশব্যাক করা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া ভারতীয়সহ অন্যান্য দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশে জোরপূর্বক ঠেলে দেওয়ার ঘটনায় ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইতোমধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। তবে দেশটির সরকার বিষয়টি এখনও আমলে নেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

পুশইন ইস্যুতে বিজিবি কর্মকর্তারা বলছেন, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে পুশইনের ঘটনায় পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে মৌখিক ও লিখিতভাবে বিএসএফের কাছে জোরালো প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে সব সময়। সংবেদনশীল সীমান্ত এলাকায় বিজিবি উচ্চ সতর্কতায় রয়েছে। সেখানে নজরদারি এবং টহল জোরদার করা হয়েছে। কিন্তু বিএসএফ পুশইন বন্ধ করেনি।

এদিকে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশে একের পর এক পুশইনের ঘটনায় পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে বিজিবির জোরালো প্রতিবাদের পাশাপাশি কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে এর সমাধান চেয়ে আসছে বাংলাদেশ। পুশইন ইস্যুতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার ভারতকে একাধিক চিঠি দিয়ে ঘটনাকে ‘গভীর উদ্বেগজনক’ বলে উল্লেখ করেছে। ১৯৭৫ সালের যৌথ সীমান্ত নির্দেশিকা, ২০১১ সালের সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা এবং বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের আলোচনায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর সঙ্গে এ ধরনের কর্মকা- যে সাংঘর্ষিক, তা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে না দিয়ে তাদের আদি নিবাস মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু পুশইন বন্ধের বিষয়ে গতকাল পর্যন্ত ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যে কারণে গতকালও ৪৬ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

ভারতের দিক থেকে যেটা পুশব্যাক, বাংলাদেশের চোখে সেটাই পুশইন। সীমান্তে পুশব্যাক বা পুশইন আসলে এমন একটা পদ্ধতি যেখানে ধরা পড়া ব্যক্তিদের সীমান্তে নিয়ে গিয়ে অন্য দেশের সীমান্তে ঠেলে দেওয়া হয়ে থাকে।

এ প্রক্রিয়ার কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই। এটি আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হিসেবে দেখছেন মানবাধিকার কর্মীরা। অন্যদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির নতুন কৌশল হিসেবে ‘পুশইন’ চলছে। যে কারণে পুশইন বন্ধে ঢাকার পক্ষ থেকে দিল্লিকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ করা হলেও এ ব্যাপারে দেশটি পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

গত ২২ এপ্রিল ভারত শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার পর দেশটিতে অনুপ্রবেশকারীদের ধরতে অভিযান শুরু করে ভারত। অবৈধভাবে ভারতে বসবাসকারীদের আটকের পর এদের অনেককেই বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে বিএসএফ। এরপর দিনের পর দিন বাংলাদেশে পুশইন বাড়তে থাকে। এই পুশইন ঠেকাতে কোনো কোনো সীমান্তে বিজিবির পাশাপাশি সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারাও রাত জেগে পাহারা বসায়। এতে অনেক পয়েন্টে পুশইন করতে ব্যর্থ হয় বিএসএফ।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিজিবি সূত্রের খবর অনুযায়ী, গত ৭ মে থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত বিএসএফ বাংলাদেশের ২২টি জেলার সীমান্ত এলাকা দিয়ে ১৫৬০ জনকে বাংলাদেশে পুশইন করেছে। তাদের মধ্যে ১৩৮৬ জন বাংলাদেশি নাগরিক, ৬৪ জন মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা এবং ১১০ জন ভারতের নাগরিক। ১৫৬০ জনের মধ্যে ১৫৫৬ জনকেই পুশব্যাক করেছে বিজিবি। এ হিসাবের বাইরে ১৮ জুন থেকে গতকাল ২৪ জুন পর্যন্ত আরও ১৩৫ জনকে পুশইন করা হয়েছে। এর মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার সিলেট, সুনামগঞ্জ ও লালমনিরহাট সীমান্ত দিয়ে আরও ৪৬ জনকে পুশইন করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ। বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, নওগাঁ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার, কুড়িগ্রাম, সিলেট, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, ফেনী, কুমিল্লা, ঝিনাইদহ, হবিগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জ ও কুষ্টিয়া জেলা দিয়ে ইতোমধ্যে পুশইন করা হয়েছে। এ ছাড়া সুন্দরবন এলাকা দিয়ে ৭৮ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়। যাদের কেউ কেউ দেশে পুশইনের পর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ করেন।

৪৮ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. নাজমুল হক গতকাল মঙ্গলবার আমাদের সময়কে বলেন, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্ত দিয়ে মঙ্গলবার (গতকাল) ৩৯ জনকে ঠেলে দেওয়া হয়। তাদের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার মিনাটিলা সীমান্ত দিয়ে ১৯ জনকে ঠেলে পাঠায় বিএসএফ সদস্যরা। তাদের মধ্যে তিনটি পরিবারের নারী, পুরুষ ও শিশু রয়েছেন। তাদের সবার বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলায়।

অন্যদিকে, সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার নোয়াকোট সীমান্ত দিয়ে আরও ২০ জনকে ঠেলে পাঠানো হয়। তাদের মধ্যে তিনটি পরিবারের নারী, পুরুষ ও শিশু রয়েছেন। আটক ২০ জনের মধ্যে ১৯ জনের বাড়ি কুড়িগ্রাম ও একজনের বাড়ি পাবনায়। এ ছাড়া গতকাল লালমনিরহাটের পাটগ্রাম সীমান্ত দিয়ে আরও ৭ জনকে বাংলাদেশে পুশইন করেছে বিএসএফ। ভোর পাঁচটার দিকে উপজেলার বাউরা ইউনিয়নের হোসনাবাদ সীমান্ত দিয়ে তাদের ঠেলে দেওয়া হয়।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. নাজমুল হক বলেন, সীমান্তে পুশইন ঠেকাতে বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয়দেরও এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

জানা গেছে, বাংলাদেশে পুশইন করা ব্যক্তিদের মধ্যে ইউএনএইচসিআর-এর কার্ডধারী কিছু রোহিঙ্গাও রয়েছে। আবার যারা ভারতীয় রোহিঙ্গা, তাদেরও পুশইন করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আর ভারতীয় নাগরিকদের জোরপূর্বক বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর ঘটনায় দেশটির মানবাধিকার সংগঠনগুলো সরকারের এ সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করছে। বাংলাদেশে যে ১১০ জনকে ভারতীয় নাগরিককে ঠেলে পাঠানো হয় তাদের বৃত্তান্ত যাচাই করে বিজিবি জানতে পারে তারা ভারতীয় নাগরিক। এরপর তাদের মধ্যে ১০৬ জনকে পুশব্যাক করা হয়েছে।