রাতে মুখস্থ করিয়ে সকালে আদালতে সেই স্বীকারোক্তি
গুম হওয়া ব্যক্তিদের দীর্ঘদিন পর আদালতে হাজির করার আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একটি স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য লিখে দিত। পরীক্ষার আগের রাতের মতো ভুক্তভোগীদের তা মুখস্থ করানো হতো। পরে তারা আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে মুখস্থ করা সেই স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দিতে বাধ্য হতেন। এ ছাড়া আসামিদের মুখস্থ করানো বক্তব্য আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটের কাছেও থাকত। পরে সেই বক্তব্যকেই স্বীকারোক্তি হিসেবে ভুক্তভোগীকে স্বাক্ষর করতে হতো।
গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ : আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন।
গুম সংক্রান্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়Ñ বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা বিশেষ করে আদালত ও প্রসিকিউশন পদ্ধতিগতভাবে রাজনৈতিক মতবিরোধ দমন এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি থেকে রক্ষা করার জন্য অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন জেলা ও সংস্থার মধ্যে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য সাক্ষ্য থেকে স্পষ্টভাবে একটি ভয়ঙ্কর ধারাবাহিকতা প্রতীয়মান হয় যে, গুম বা বেআইনিভাবে আটক ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য আদায় করা হয়েছে। এই বর্ণনাগুলোর অভিন্নতা ইঙ্গিত দেয় যে, একটি সমন্বিত পদ্ধতির মাধ্যমে জোরপূর্বক, প্রক্রিয়াগত লঙ্ঘন ও প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার মাধ্যমে কথিত আত্ম-অপরাধমূলক বক্তব্য তৈরি করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভুক্তভোগীদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যদি তারা ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সই না করে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নির্ধারিত বক্তব্য না দেয়, তাহলে তাদের ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক ব্যক্তিরা ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করেছেন যে, তাদেরকে হুমকি, শারীরিক নির্যাতন ও মানসিক চাপের মধ্যে রাখা হয়েছে। এসবের মধ্যে ছিল হত্যার হুমকি, দীর্ঘ সময় নিখোঁজ করে রাখা, পরিবারের সদস্যদের ক্ষতির আশঙ্কা এবং বারবার নির্যাতন। অনেক ক্ষেত্রে, ভুক্তভোগীদের হুশিয়ারি দেওয়া হয় যে, নির্ধারিত বয়ান মেনে না চললে তাদের মেরে ফেলা হবে বা তাদের বিরুদ্ধে আরও গুরুতর মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করা হবে।
একজন ভুক্তভোগী গুম কমিশনের কাছে জানিয়েছেন, চার মাস আটকে রাখার পর আমাকে বলা হলোÑ ‘তুমি কি এখান থেকে বের হতে চাও, না কি এখানেই শেষ হয়ে যেতে চাও?’ আমি বললাম, ‘অবশ্যই বের হতে চাই।’ তখন বলল, ‘তাহলে আমরা যা বলব, তুমি আদালতে ঠিক তাই বলবে। না বললে তোমাকে গুলি করে মারব। তুই যদি স্বীকারোক্তি না দিস, তাহলে তোর বউকে নিয়ে আসব, তাকে ইলেকট্রিক শক দেব। এখানে কেউ বাঁচাতে পারবে না।
ভুক্তভোগী বলেন, একটা কাগজ লিখে দিল, যাতে বলা হয়েছেÑ কীভাবে স্বীকারোক্তি দিতে হবে। বলল যে, এভাবে বলবে, না বললে বাঁচিয়ে রাখব না। চার দিন সময় দিয়েছে মুখস্থ করার জন্য। বলেছে, ‘এই কথা মুখস্থ করো, না বললে পাঁচ-সাতটা মামলা দিয়ে দেব, আর বললে একটা ছোট মামলা দিয়ে ছেড়ে দেব। রাতভর আমাকে পড়িয়েছে। কিন্তু আমি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়ে বলেছি, ‘স্যার, আমি কিছু করিনি। তারা মারধর করে এগুলো বলিয়েছে।’ ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি দেখছি।’ কিন্তু তারপরও উনি আমার বিরুদ্ধে তা-ই লিখেছেন।
একাধিক সাক্ষে উঠে এসেছে যে, ম্যাজিস্ট্রেটরা স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়েছে কি না, তা যাচাই করার ন্যুনতম আইনি বাধ্যবাধকতাও পালন করেননি। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, যেসব কর্মকর্তা তাদের নির্যাতন করেছেন, তারাই তাদের ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করেছেন। সেখানে তারা স্বাধীনভাবে কিছু বলার সুযোগ পাননি। এ অবস্থাতেই তাদের রিমান্ডে পাঠানো হতো। কিছু ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটরা উদাসীন বা তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিলেন এবং কোনো প্রশ্ন ছাড়াই কেবল কাগজে সিল দিয়ে দিতেন। আবার কিছু ভুক্তভোগীর মতে, স্বীকারোক্তিমূলক নথিতে যা লেখা ছিল, তার সঙ্গে তাদের কথার কোনো মিলই ছিল না।
আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তির বর্ণনা দিয়ে অপর একজন ভুক্তভোগী বলেন, আমি ম্যাজিস্ট্রেটকে বললাম যে, ওনারা আমাকে রিমান্ডে রেখেছে। আমার বাবা-মা জানে না আমি বেঁচে আছি নাকি মারা গেছি। এখানে যা লেখা হয়েছে, আমাকে মুখস্থ করানো হয়েছে। স্যার, আমি এই সম্পর্কে কিছুই জানি না। এরপর ম্যাজিস্ট্রেট কিছু লেখা কেটে দিলেন। বললেন, দেখো, অনেক কিছু কেটে দিয়েছি, আর কাটা যাবে না। যা আছে এখানেই সাইন করো। ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে বললেন, তোমার তো এত জায়গা-জমি নেই যে আমি লিখে নিয়ে যাব। সাইন করতে বলেছি, সাইন করো।
অপর এক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, ম্যাজিস্ট্রেট যেভাবে লিখেছেন, তাতে বলা হয়েছেÑ আমি জিহাদি কর্মকা-ে জড়িত ছিলাম। আমি তাকে এই কথাগুলো কখনও বলিনি। তিনি নিজের মতো করে লিখে ফেললেন। র?্যাবের লোকেরা যখন ১৬৪ কক্ষের (জবাববন্দি প্রদানের স্থান) ভেতরে ঢুকালেন, তখন আমার চোখ বাঁধা ছিল। এটা যে ১৬৪ কক্ষ, তা-ও আমি জানতাম না। র?্যাবের পক্ষ থেকে আমাকে বলা হয়েছিল, যেভাবে শিখিয়েছি, সেভাবেই বলবে। যদি না বলিস, এখান থেকে বের করে তোকে আর জীবনে দেখবে না।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরের পর বছর এবং বিভিন্ন অঞ্চলের মামলাগুলোর বিশ্লেষণে দেখা যায়, গ্রেপ্তারের পরপরই সন্দেহভাজনদের কাছ থেকে তারা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সদস্য হওয়ার স্বীকারোক্তি দিয়েছেনÑ এমন দাবি বারবার করেছে কর্তৃপক্ষ। অথচ আদর্শবাদী কর্মীদের এমন আচমকা এবং বিস্তারিত স্বীকারোক্তি অস্বাভাবিক। সাধারণ অপরাধীদের তুলনায়, তারা নিজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। তাই এই স্বীকারোক্তিগুলোর সময় এবং স্বরূপ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
গ্রেপ্তারের পর সাজানো গল্প : বছরের পর বছর দেশের নানা প্রান্তে একই ধরনের অভিযোগের পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। গ্রেপ্তারের সময় সন্দেহভাজন ব্যক্তি পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিল, ফলে তাৎক্ষণিক ধাওয়া দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে বলা হয়েছে। ‘পালানোর চেষ্টা’ নামক এই গল্পটি নারায়ণগঞ্জ থেকে গাজীপুর, চট্টগ্রাম থেকে বগুড়া পর্যন্ত প্রায় সব জেলায় অভিযোগপত্রে একইভাবে উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, পুলিশি অভিযানে পরোয়ানা ছাই গ্রেপ্তারের জন্য এটি একটি পূর্বনির্ধারিত ব্যাখ্যা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।