খেলাপির আধিক্যে ব্যাংকে প্রভিশন ঘাটতির রেকর্ড
ব্যাংক খাতে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। আর এ ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে অনেক ব্যাংক। ফলে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে মোট প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। মাত্র তিন মাস আগে গত ডিসেম্বরে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে মার্চÑ এই তিন মাসে ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ৬৪ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা।
এর আগের প্রান্তিক, অর্থাৎ ডিসেম্বর ২০২৩ থেকে মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত ঘাটতি বেড়েছিল প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা। আরও উদ্বেগজনক তথ্য হলোÑ গত এক বছরে এই ঘাটতির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৬ গুণ। ২০২৪ সালের মার্চে প্রভিশন ঘাটতি ছিল মাত্র ২৬ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা।
ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করে, তার বেশিরভাগই আমানতকারীদের অর্থ। আমানতকারীদের অর্থ যেন কোনোভাবে ঝুঁকির মুখে না পড়ে, সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে। এর একটি হলো প্রভিশন সংরক্ষণ।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
প্রভিশন ঘাটতির বেশিরভাগ দায় পড়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর। মার্চ শেষে এই খাতে তাদের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংকের ঘাটতি ৬৩ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা। তবে বিশেষায়িত ও বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলো এ ঘাটতির বাইরে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী, বিভিন্ন ধরনের ঋণের বিপরীতে নির্দিষ্ট হারে প্রভিশন সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক। যেমন- নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে ৫ শতাংশ, সাব-স্ট্যান্ডার্ডে ২০ শতাংশ, সন্দেহজনকে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রভিশন ঘাটতির কারণে ব্যাংকগুলো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না, আন্তর্জাতিক লেনদেনে অতিরিক্ত চার্জ গুনতে হয়, এমনকি মূলধন ঘাটতির ঝুঁকিও থাকে। ফলে এই সূচকটি ব্যাংকগুলোর দুর্বল আর্থিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরে, যা মূলত উচ্চ খেলাপি ঋণের ফল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কিছু প্রভাবশালী গ্রুপ নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে বিশাল অংকের ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দিয়েই লোপাট করেছে। তাদের সুবিধা দিতে বিভিন্ন সময়ে নীতিমালাও শিথিল করা হয়, যাতে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কম দেখানো যায়। সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক সেই নীতিমালা থেকে সরে আসে। ফলে এখন প্রকৃত খেলাপির চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে। ইতোমধ্যে এস আলম, বেক্সিমকোসহ শীর্ষ কয়েকটি গ্রুপের নামও খেলাপির তালিকায় যুক্ত হয়েছে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। মাত্র এক বছর আগে ২০২৪ সালের মার্চে এই খেলাপির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা ছিল মোট ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা- যা দ্বিগুণেরও বেশি। শুধু জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা।