দেশে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির শঙ্কা

প্রভাব পড়তে পারে পুরো খাতে

লুৎফর রহমান কাকন
১৫ জুন ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
দেশে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির শঙ্কা

জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভর দেশ বাংলাদেশ। ফলে বৈশি^ক যে কোনো সংকটেই বাংলাদেশের জ্বালানি খাত প্রভাবিত হয়। করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের দাম বৃদ্ধি যে কোনো ইস্যুতেই বাংলাদেশের জ্বালানি খাত টালমাটাল হয়ে পড়ে। এবারও দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে এরই মধ্যে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। যদি এ যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হয়, তবে আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের বাজারে বড় ধরনের প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে।

গত শুক্রবার ইরানের একাধিক পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনার ওপর হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। ভূরাজনৈতিক এই উত্তেজনার কারণে ইরান থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে বিশ^বাজারে গতকাল জ্বালানি তেলের দাম ৯ শতাংশের বেশি বেড়ে কয়েক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ইরানে ইসরায়েলি হামলার পর জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে ৯ শতাংশের কাছাকাছি বেড়ে গেছে, যা কয়েক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এখন দুই পক্ষের হামলা পাল্টা হামলা চলতে থাকলে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে, যার প্রভাব পড়বে বিশ^ব্যাপী। বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের মতো দুর্বল অর্থনীতির এবং জ্বালানিতে আমদানিনির্ভর দেশগুলো।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট অপরিশোধিত তেলের দামও বেড়েছে। ব্যারেলপ্রতি ৬ ডলার ২২ সেন্ট (৯ দশমিক ১ শতাংশ) বেড়ে দাম ঠেকেছে ৭৪ ডলার ২৬ সেন্টে। এ তেলের দাম তাৎক্ষণিকভাবে ৭৭ ডলার ৬২ সেন্টে উঠে গিয়েছিল, যা ছিল ২১ জানুয়ারির পর সর্বোচ্চ। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর পর এই প্রথম এক দিনে এত বড় উত্থান দেখা গেল।

ইরানের ন্যাশনাল অয়েল রিফাইনিং অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি জানিয়েছে, তাদের শোধনাগার ও মজুদ রাখার স্থাপনার কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি; কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান এসইবির বিশ্লেষক ওলে ভ্যালবাই মনে করেন, প্রাথমিক উদ্বেগের বিষয় হলো, হরমুজ প্রণালী নিয়ে। মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনার প্রভাব এ জলপথে পড়ার ঝুঁকি আগে থেকেই ছিল। তবে সর্বশেষ খবরে জানা যায় ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবছে।

বিশ্বে যে পরিমাণ তেল ব্যবহার হয়, তার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এ পথে পরিবহন করা হয়। সে হিসেবে, হরমুজ প্রণালী দিয়ে প্রতিদিন তেল আনা-নেওয়া হয় ১৮ থেকে ১৯ মিলিয়ন ব্যারেল।

সুইস প্রতিষ্ঠান ‘স্পার্টা কমোডিটিসের’ বিশ্লেষকরা বলছেন, সরবরাহে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটলে শোধনাগারগুলো ভারী তেলের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত হালকা তেলের দিকে ঝুঁকবে।

জেপি মরগানের বিশ্লেষকরা সতর্ক করে দিয়ে বলেন, হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে গেলে কিংবা তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর পাল্টা ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি খুবই নাজুক হয়ে পড়বে। ব্যারেলপ্রতি দাম উঠতে পারে ১২০ থেকে ১৩০ ডলার পর্যন্ত, যা বর্তমান পূর্বাভাসের প্রায় দ্বিগুণ।

এদিকে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে বাংলদেশের জ্বালানি তেলের কী প্রভাব পড়তে পারে- জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, যুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয় এবং হরমুজ প্রণাণী বন্ধ থাকে, তাহলে অবশ্যই প্রভাব পড়বে। দাম বেড়ে যেতে পারে। একই সঙ্গে পরিবহনে সংকট তৈরি হতে পারে। তিনি বলেন, যুদ্ধের কারণে জাহাজ ভাড়া এবং স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ থাকতে পারে। অথবা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য জাহাজ চলাচল বা তেল বিক্রি বন্ধ থাকতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো প্রভাব পড়েনি। তিনি বলেন, তবে বাংলাদেশ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সময় ১০০ ডলারের উপরে দাম দিয়েও জ্বালানি তেল কিনেছে। আমরা আশা করব, দ্রুতই এই যুদ্ধের অবসান হবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় জ্বালানির প্রায় সবই আমদানি করতে হয়। বছরে প্রায় ৮৫ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়। এ ছাড়া গ্যাসের প্রায় ২৫ শতাংশ এলএনজি আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয়। একই সঙ্গে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ৯০ শতাংশ কয়লাই আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে হয়। গৃহস্থালি রান্নার এলপিজি বিদেশ থেকে আমদানি করে সরবরাহ করা হয়। ফলে যুদ্ধ চললে পুরো জ্বালানি খাতই প্রভাবিত হতে পারে।