হতাশার মধ্যেও প্রস্তুতি ট্যানারি মালিকদের
ভালো নেই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি আয়ের খাত চামড়া শিল্পের উদ্যোক্তারা। অসংখ্য সমস্যা, সীমাবদ্ধতা, অপ্রাপ্তি আর জটিলতার জেরে বছরের পর বছর ধরে তারা লোকসান দিচ্ছেন। অনেক উদ্যোক্তা ইতোমধ্যেই সর্বস্ব হারিয়ে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। এত কিছুর পরও আসন্ন কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে তাদের মধ্যে চলছে চামড়া কেনার প্রস্তুতি, দেখছেন সুদিনের স্বপ্ন।
সাভারের হেমায়েতপুরের চামড়া নগরীর সমস্যার সমাধান হবে; সরকারের পক্ষ থেকে নীতি সহায়তা মিলবে; হাজারীবাগের ট্যানারির জমি রাজউক ডেভেলপ করবে; পরিবেশবিষয়ক এলডব্লিউজি সনদ পাওয়া যাবেÑ এমন আশায় বছরের পর বছর পার করছেন চামড়া শিল্পের উদ্যোক্তারা। কিন্তু কোনো কিছুরই সমাধান হয়নি। লোকসানের পর লোকসান দিয়ে ট্যানারি চালু রাখছেন তারা। গত বছরের ৪০ শতাংশের বেশি চামড়া এখনও পড়ে আছে গুদামে। আন্তর্জাতিক সনদ এলডব্লিউজি না থাকায় রপ্তানি হচ্ছে না। গত এক দশকে চামড়া রপ্তানি কমেছে প্রায় ৬৪ শতাংশ। এমন দুর্দশার মধ্যেও প্রতি বছরই উদ্যোক্তারা কোরবানির পশুর চামড়া কিনছেন। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না। সরকার নির্ধারিত দামেই চামড়া কিনতে প্রস্তুত ট্যানারি মালিকরা। তবে তাদের উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তাদের কারণে চামড়ার বাজারে সৃষ্টি হয় কৃত্রিম অস্থিরতা। তারা একদিকে নামমাত্র মূল্যে চামড়া সংগ্রহ করে, অন্যদিকে চামড়া সংরক্ষণের সঠিক নিয়ম জানা না থাকায় অধিকাংশ চামড়া যায় পচে। এসব পচা চামড়া কিনতে ট্যানারিগুলো অনীহা প্রকাশ করলেই সৃষ্টি হয় সমস্যা। তখনি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কখনও রাস্তায় ফেলে দেয় আবার কখনও মাটিতে পুঁতে ফেলে। এতে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে যে, চামড়ার দাম নেই। এমন অস্থিরতা থেকে রক্ষা করতে এবার সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, ১০ দিন রাজধানীতে ঢুকতে পারবে না ঢাকার বাইরের চামড়া। এতে কিছুটা হলেও দেশীয় সম্পদ রক্ষা পাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
এদিকে ট্যানারিগুলো চামড়া কিনতে প্রস্তুত হলেও প্রস্তুত হয়নি কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি)। কোরবানির মৌসুমে ৩২-৩৫ হাজার ঘন মিটার বর্জ্য পরিশোধনের প্রয়োজন হলেও সক্ষমতা আছে মাত্র ১৪ হাজার ঘন মিটারের।
এ খাত সংশ্লিষ্টারা বলছেন, দেশের কাঁচা চামড়া রপ্তানি শিল্পের উৎপাদন সক্ষমতা যথেষ্ট হলেও এর বড় বাধা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) মান সনদ। ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চমূল্যের বাজারে প্রবেশের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ গৃহপালিত পশুপালনে বিশে^র শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি হওয়ার পরও ২৪৪ বিলিয়ন ডলারের কাঁচা চামড়া উৎপাদনের বৈশি^ক বাজারে বাংলাদেশের হিস্যা ০ দশমিক ৫ শতাংশেরও কম।
জানা গেছে, দেশে প্রচুর পরিমাণে কাঁচা চামড়া থাকার পরও যথাযথ সংরক্ষণ ও আন্তর্জাতিক মান সনদের অভাবে এর বেশির ভাগ ব্যবহার করা যায় না।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
সাভারের ট্যানারি পল্লীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) সক্ষমতা, চামড়া সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণেই কার্যত এ সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
ফিনিশড লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন আমাদের সময়কে বলেন, চামড়া খাতকে বাঁচাতে হলে বিশেষ নীতি সহায়তা প্রয়োজন। পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। তিনি বলেন, চামড়া শিল্প এখন আইসিইউতে আছে। সিইটিপি অসম্পূর্ণ থাকার কারণে বর্তমানে আন্তর্জাতিক যে বাজার দর আছে, আমরা সেই তুলনায় ৭০-৮০ শতাংশ কম দামে চীনে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। আমরা যদি এটার ভ্যালু এডিশন বাড়াতে পারি, তাহলে আগের দামে চামড়া কিনতে পারতাম।
মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিসিক শিল্প নগরিতে ট্যানারি মালিকদের যে অংশগ্রহণ, সেটা যথার্থই ছিল। ব্যর্থ যেটা হয়েছে, সেটা সরকারি প্রতিষ্ঠান বিসিকের কারণেই হয়েছে। কাজেই ব্যর্থতার দায় কোনো অবস্থাতেই ট্যানারি মালিকদের ওপর বর্তায় না।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোশিয়েশনের (বিটিএ) তথ্যানুসারে, বর্তমানে প্রতি বর্গফুট চামড়া বৈশ্বিক ক্রেতাদের কাছে প্রায় এক ডলারে বিক্রি করে বাংলাদেশ। পরিবেশগত মান অর্জন করা গেলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন বাজারে দাম আরও ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বেশি পাওয়া যেতে পারে। ফলে চীনের বাজারের ওপর দেশের চামড়া শিল্পের নির্ভরতা বাড়ছে। দেশটিতে মূলত ক্রাস্ট এবং ফিনিশড চামড়া রপ্তানি করা হয়।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, কাঁচা চামড়ার প্রয়োজনীয় সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায়, বিশেষ করে সিইটিপির অভাবে দেশের চামড়া শিল্পের বৈশি^ক চাহিদা কমছে। এ কারণে দিন দিন এ শিল্প খারাপের দিকে যাচ্ছে। কোরবানির মৌসুমে বিপুল চামড়া সংগ্রহ করা হলেও অব্যবস্থাপনার কারণে অনেক চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া ক্রেতার অভাবে অনেক চামড়া অবিক্রীত থাকে। গত বছরের প্রায় ৪০ শতাংশ চামড়া এখনও অবিক্রীত। এবার কোরবানির ঈদেও চামড়া সংগ্রহ অনেক কম হবে বলে মনে করছেন তিনি।
এদিকে কোরবানির চামড়ার চাহিদা বৃদ্ধি করতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। গত এক দশকের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে এবার কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে চায় সরকার। যে কারণে কাঁচা ও ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির শর্ত তিন মাসের জন্য শিথিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাঁচা-ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানি করা গেলে দেশে চামড়ার চাহিদা বাড়বে, ভালো দাম পাবেন বিক্রেতারা।
এদিকে সম্প্রতি ঢাকা চেম্বারের এক সেমিনারে বক্তারা বলেন, সিইটিপির সমস্যা অব্যাহত থাকায় ১০ বছরে চামড়া রপ্তানি ৬৪ শতাংশ কমেছে। তারা বলেন, সিইটিপি কার্যকর করা গেলে চামড়া রপ্তানি দ্বিগুণ হবে।
বিনামূল্যে ৩০ হাজার টন লবণ দেবে সরকার
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
আসন্ন ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণে এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিংসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিনামূল্যে ৩০ হাজার টন লবণ দেবে সরকার। গত ২১ মে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত কোরবানি সম্পর্কিত বিষয়াদির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ কমিটির প্রথম সভা শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন।
এ বছর ঢাকায় গরুর লবণযুক্ত চামড়ার প্রতি বর্গফুটের দাম গত বছরের তুলনায় ৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এ বছর ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। অন্যদিকে ঢাকার বাইরে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা।