অর্থনীতিতে সাত চ্যালেঞ্জ

আবু আলী
০৫ জুন ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
অর্থনীতিতে সাত চ্যালেঞ্জ

দেশের আর্থিক খাত বর্তমানে তীব্র চ্যালেঞ্জে রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এ ছাড়াও অনাদায়ী ঋণ (এনপিএল) বেড়ে যাওয়া, কিছু ব্যাংকের দুর্বল অবস্থা এবং চলমান তারল্য সংকট অন্যতম। যদিও কিছু ব্যাংক তাদের অবস্থা উন্নত করেছে, কিন্তু অনেক ব্যাংক এখনও দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। সুশাসন, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, আইনগত আদায় এবং দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত না করতে পারলে আর্থিক খাতের এই দুর্বলতা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। একই সঙ্গে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হবে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে (২০২৫-২৬ থেকে ২০২৭-২৮) বাজেট বাস্তবায়নে অন্তত সাতটি চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেট ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে আশাব্যঞ্জক নয়। অন্যদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিনিয়োগের বাধা কাটানোর জন্য বাজেটে তেমন কোনো বার্তা নেই।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে কঠোর মুদ্রানীতির পাশাপাশি সহায়ক রাজস্ব নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এসব পদক্ষেপ সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। সরকারের দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ রপ্তানি খাত। নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি রপ্তানির ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের ৩৭ শতাংশ শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত তিন মাসের জন্য স্থগিত করলেও এটি রপ্তানিকারকদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এতে নতুন অর্থবছরে রপ্তানি খাতে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন চ্যালেঞ্জিং হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে জিডিপির অনুপাতে রাজস্বের নিম্নহার। বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহে সরকারের সক্ষমতার অভাব দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধি অর্জনে বড় বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

চতুর্থ চ্যালেঞ্জ হিসেবে উচ্চ সুদহারের বিষয়টি তুলে ধরে বলা হয়, বাজারে সুদের হার বৃদ্ধির কারণে ব্যবসাবাণিজ্যে বাধা সৃষ্টি করছে। আগামী দিনগুলোয় মূল্যস্ফীতি না কমলে বেসরকারি বিনিয়োগ গতি হারাতে পারে; স্থবির হয়ে যেতে পারে বিদেশি বিনিয়োগ। ফলে বেকারত্ব বাড়বে, প্রবৃদ্ধিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।

খেলাপি ঋণ ও তারল্য সংকটের কারণে বর্তমানে আর্থিক খাত তীব্র চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, কিছু ব্যাংক উন্নতি করতে পারলেও বেশ কয়েকটি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। কঠোর সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, আইনি পুনরুদ্ধার এবং দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণে ব্যাংক সংস্কার না হলে আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

এ ছাড়া এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাণিজ্য সুবিধা হারানো, রপ্তানি প্রতিযোগিতা বজায় রাখা, জলবায়ু তহবিল কমে আসা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ যে দুর্যোগ ঝুঁকিতে রয়েছে সে বিষয়গুলো মধ্যমেয়াদে অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে নীতি বিবৃতিতে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আশা, স্থিতিশীল নীতিমালা ও খাতভিত্তিক উন্নয়নের মাধ্যমে মধ্যমেয়াদে অর্থনীতি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াবে। ২০২৭-২৮ অর্থবছরের মধ্যে প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

মন্ত্রণালয়ের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে (এমটিএমপিএস)-তে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখন সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার। কঠোর মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির কারণে বর্তমানে একটি সীমিত ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যেখানে উচ্চ নীতিগত হারের কারণে বাজারে সুদের হারও বেড়েছে। আগামী মাসগুলোতে যদি মূল্যস্ফীতি না কমে, তাহলে বেসরকারি বিনিয়োগের গতি কমে যেতে পারে এবং প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) স্থবির হয়ে পড়তে পারে। এতে বেকারত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির ওপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে, যা অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে।

মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের রপ্তানির ওপর চলতি বছর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, যদিও তা ৯০ দিনের জন্য সাময়িকভাবে স্থগিত রয়েছে। এতে রপ্তানিকারকদের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদের এপ্রিলের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাসে বলেছে, ২০২৫ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি কমে ২ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশের পণ্যের বৈদেশিক চাহিদাও কমতে পারে। এই পরিস্থিতিতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ১০ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা কঠিন হতে পারে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ এখনও কর-জিডিপি অনুপাতের দীর্ঘস্থায়ী দুর্বলতার মুখোমুখি। ফলে সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। এতে উন্নয়ন ও সামাজিক খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ ব্যাহত এবং দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা ক্ষুণœ হচ্ছে।

অর্থ বিভাগ জানিয়েছে, জলবায়ু ঝুঁকি সূচকের ২০২৫ সালের পূর্বাভাস অনুযায়ী জলবায়ুজনিত দুর্যোগের কারণে প্রতিবছর প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়- যা দেশের জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ। এতে প্রতি বছর ৬ দশমিক ৩ মিলিয়নের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। এই ধরনের দুর্যোগ বারবার ঘটায় সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি কমানো এবং জলবায়ু সহনশীলতা বাড়াতে বিস্তৃত মূল্যায়ন ও কার্যকর কৌশল নেওয়া জরুরি বলে জানিয়েছে অর্থ বিভাগ।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের সম্পদ সীমিত, চাহিদা অনেক বেশি। বাইরে থেকে সম্পদ আনা, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ, পুঁজিবাদের অবস্থা, ব্যাংকের অবস্থা, আইনশৃঙ্খলা অবস্থা সব মিলিয়ে একটা বিশৃঙ্খলা। এর ভেতরেই আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। ক্রান্তিলগ্নে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে সবাই মিলে চেষ্টা করে দেশটাকে একটা স্থিতিশীল অবস্থান নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। আমরা দায়িত্বটা একটা কঠিন সময়ে নিয়েছি। সংসদ না থাকায় জাতির সামনে বাজেট পেশ করেছি এবং এ জন্য আমরা জাতির কাছে দায়বদ্ধ। আমরা এমন এক সময় বাজেট উপস্থাপন করেছি, যখন দেশের অর্থনীতি আইসিইউ পর্যায়ে রয়েছে। এই বাস্তবতায় আমরা একটি বাজেট দিয়েছি, এখন বাস্তবায়নের চেষ্টা করব।