প্রতিদিন তামাক কেড়ে নেয় ৪৪২ জনের প্রাণ
আজ বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। তামাক এবং নিকোটিন কোম্পানি তাদের ক্ষতিকর পণ্য ভোক্তার কাছে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে যে ধরনের কৌশল অবলম্বন করে, সেগুলো উন্মোচন করার লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘আনমাস্কিং দি অ্যাপিল : এক্সপোজিং ইন্ডাস্ট্রি ট্যাক্টিকস অন টোব্যাকো অ্যান্ড নিকোটিন প্রোডাক্টস’।
বাংলাদেশে দিবসটি নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালন করার কথা রয়েছে। গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা প্রতি বছরের মতো এবারও বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য নিয়ে একটি তথ্যচিত্র প্রস্তুত করেছে। গতকাল সকালে মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা-মানস জাতীয় প্রেসক্লাবে আলোচনা সভার আয়োজন করে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে মাদক বিষয়ে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান হতে পারে বলে জানা গেছে।
মানস ও প্রজ্ঞার গবেষণা থেকে জানা গেছে, প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক মানুষ মাদকাসক্ত। এ থেকে কী কী রোগ হচ্ছে, মাদক ব্যবহার না করেও কী পরিমাণ মানুষ পরোক্ষ মাদক ব্যবহারের শিকার, এর অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ কী তা জানা গেছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন ক্যাটাগরি তৈরি করে এই দুটি সংস্থা তাদের গবেষণাপত্র তুলে ধরেছে। দুটি প্রতিষ্ঠানই মাদক থেকে রেহাই পাওয়ার বিভিন্ন উপায় তুলে ধরেছেন।
প্রজ্ঞা ‘গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে ২০১৭’-এর তথ্য উল্লেখ করে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ (১৫ বছর বা বেশি) তামাক ব্যবহার করে। অন্যদিকে ৩ কোটি ৮৪ লাখ মানুষ ধূমপান না করেও বিভিন্ন গণপরিবহন ও পাবলিক প্লেসে প্রতিনিয়ত পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। ১৩-১৫ বছরের অপ্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যেও ৭ শতাংশ হারে তামাকের ব্যবহার দেখতে যায়। ‘টোব্যাকো এটলাস ২০১৮’-এর তথ্যমতে, তামাক ব্যবহারজনিত রোগে প্রতি বছর বাংলাদেশে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করেন। সে হিসাবে প্রতিদিন ৪৪২ জন মানুষ প্রাণ হারান। এ ছাড়া এ থেকে ক্যানসারসহ নানা রোগ হয়ে থাকে। এসব কারণে তামাককে মহামারী হিসেবে গণ্য করছে প্রজ্ঞা এবং মানস।
তামাকের মহামারী সম্পর্কিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ এবং তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ও প্রণোদনা নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে এখনও সর্বোত্তম মান অর্জন করতে পারেনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রস্তাবিত সংশোধনীটি পাস হলে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের দুর্বলতাগুলো দূর হবে।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
সম্প্রতি তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের কিছু পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও এখনও বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের হার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। প্রস্তাবিত তামাক সংশোধিত আইন পাস হলে একই সঙ্গে দেশে তামাকের ব্যবহার হ্রাস পাবে ও অর্থনৈতিক ক্ষতি কমানো সম্ভব হবে বলে মনে করে প্রজ্ঞা।
শতভাগ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা : প্রজ্ঞা ও মানসের প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে- শতভাগ ধূমপানমুক্ত জনসমাগম স্থল ও গণপরিবহন নিশ্চিত করা। তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শনী বন্ধ, বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করা। তামাক কোম্পানির করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা বা সিএসআর কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা। বিশ্বের ৭৪টি দেশে তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ রয়েছে। তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে বিধিনিষেধ আরোপ। সংশোধিত আইনটি তামাকজাত দ্রব্য বিক্রির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করবে যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল বা খেলার মাঠের ১০০ মিটার সীমানার মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধ হবে। এ ছাড়াও সংশোধিত আইনটি বিড়ি-সিগারেটের সিঙ্গেল স্টিক খুুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ করবে। বিশ্বের ৩৪টি দেশে সিগারেটের খুচরা বিক্রি নিষিদ্ধ হয়েছে। ইমার্জিং টোব্যাকো এবং নিকোটিন পণ্য নিষিদ্ধ করা। সংশোধিত আইনটি ই-সিগারেট ও হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট (এইচটিপি) এবং নিকোটিন জাতীয় পণ্যের ব্যবহার, আমদানি, রপ্তানি, উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিজ্ঞাপন, প্রচার-প্রচারণা, প্রণোদনা, পৃষ্ঠপোষকতা, বিপণন এবং বিতরণ নিষিদ্ধ করবে। ভারত, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের ১০৯টি দেশে হিটেড টোব্যাকো পণ্য বা ই-সিগারেট নিষিদ্ধ। তামাকজাত দ্রব্যের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্ক বার্তার আকার বৃদ্ধি করে শতকরা ৯০ ভাগ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। ৮৯টি দেশ বাংলাদেশের তুলনায় অধিক জায়গা জুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রণ করছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সচিত্র সতর্কবাণীর আকার সবচেয়ে ছোট (মোড়কের শতকরা ৫০ ভাগ); নেপালে শতকরা ৯০, ভারতে শতকরা ৮৫ এবং শ্রীলংকায় শতকরা ৮০ ভাগ।
এই আইন বাস্তবায়িত হলে তামাক ব্যবহারজনিত প্রাণহানি কমানো সম্ভব হবে। তা ছাড়াও তামাক ব্যবহারের ফলে উৎপাদনশীলতা হারানো এবং চিকিৎসা বাবদ বছরে যে ৩০ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা ব্যয় হয় তা কমানো সম্ভব হবে বলে জানিয়েছে প্রজ্ঞা।
তামাক কোম্পানিগুলো মরিয়া হয়ে উঠেছে : মানসের সভাপতি অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী বলেন, মুনাফালোভী ধূর্ত তামাক কোম্পানিগুলো নানা অপকৌশলে তাদের মৃত্যুপণ্যের ব্যবসা সম্প্রসারণে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তামাক কোম্পানিগুলো রাষ্ট্রীয় আইন, বিধিমালা, নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করছে না। তাদের প্রধান টার্গেট শিশু-কিশোর ও তরুণরা। আগামী প্রজন্মকে তারা নেশার ফাঁদে ফেলে মুনাফার পাহাড় গড়ায় আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে এবং সেটা ঠিক এমন সময়ে যখন বাংলাদেশ ‘ইয়ুথ ডিভিডেন্ট’-এর সুফল পেতে চলেছে। তামাক কোম্পানি তাদের অশুভ লক্ষ্য বাস্তবায়নে উদগ্রীব হয়ে আছে।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
তিনি বলেন, কিশোর-তরুণদের যাতায়াত বেশি এমন বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ‘ধূমপানের স্থান’ তৈরি করছে সিগারেট কোম্পানিগুলো। যেখানে ধূমপান থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাদকও সেবন করা হয়। স্কুল-কলেজসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জনবহুল স্থান ও আশপাশে সিগারেটের দোকান, ভ্রাম্যমাণ দোকান বেশি। অথচ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে তামাকের সব ধরনের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা, পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ। স্থানীয় সরকার বিভাগের তামাক নিয়ন্ত্রণ নির্দেশিকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয় কেন্দ্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবুও তামাক কোম্পানি ব্যবসায়িক স্বার্থ চরিতার্থ করতে শিশু-কিশোর, তরুণদেরই বলির পাঁঠা বানাচ্ছে।
চলচ্চিত্র, নাটক, ওয়েব সিরিজে মাদকের ব্যবহার উৎসাহিত করা হচ্ছে : সুনির্দিষ্ট তথ্য ধরে মানস জানায়, গত ঈদুল ফিতরে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘বরবাদে’ ১২১ বার ধূমপানের দৃশ্য ছিল, যার মধ্যে নায়ককে ৮৩টি দৃশ্যে ধূমপান করতে দেখা গেছে। ১৯ বার নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য সেবনের দৃশ্য ছিল। আরেকটি চলচ্চিত্র ‘জংলি’তেও ৫৭ বার ধূমপানের দৃশ্য ছিল। ‘কাহিনীর প্রয়োজন’ এই অজুহাতে এগুলো ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে ওয়েব সিরিজগুলোতে ধূমপান, মাদকদ্রব্য, ভাষার অপব্যবহার ইত্যাদি যেন কোনো ব্যাপারই নয়।
লক্ষ্য অর্জনে দেশ অনেকখানি পিছিয়ে : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল অব এনসিডিজ’ অনুসারে বাংলাদেশে ২০১০ থেকে ২০২৫ সময়কালের মধ্যে ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী নাগরিকদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৩০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকখানি পিছিয়ে রয়েছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশে ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী নাগরিকদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ছিল ৪৩.৩ শতাংশ, যা বর্তমানে ৩৫৩ শতাংশ (সূত্র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)। এই হার কাক্সিক্ষত মাত্রায় কমিয়ে আনতে সিগারেটের মূল্য ক্রমান্বয়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাওয়া কার্যকর কৌশল বলে মনে করে প্রজ্ঞা।
সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই থাকছে সিগারেট : প্রজ্ঞা জানায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য দ্রব্যের তুলনায় বিভিন্ন স্তরের সিগারেটের দাম অল্প অল্প করে বাড়ানো হচ্ছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য তুলে ধরে সংস্থাটি জানায়, সর্বশেষ তিন অর্থবছরে (জুন ২০২৪ পর্যন্ত) চিনির দাম বেড়েছে ৮৩.৮৯ শতাংশ, মসুর ডালের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ, সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ২৬.১ শতাংশ এবং চালের দাম বেড়েছে ৯.১ শতাংশ। অন্যদিকে সিগারেটের দাম বেড়েছে মাত্র ৭.৩ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনা করলে দেখা যায়, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে সিগারেট।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম