পাহাড়ে মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা কেএনএফের
বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলার পাহাড়ে নতুন করে মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ। চট্টগ্রাম নগরীর একটি কারখানা থেকে ২০ হাজার ৩০০টি পোশাক (ইউনিফর্ম) জব্দের ঘটনা সেই বার্তাই দিচ্ছে বলে মনে করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। গত ১৭ মে বায়েজিদ বোস্তামী থানার নয়ারহাটের রিংভো অ্যাপারেলস থেকে পোশাকগুলো জব্দ করে পুলিশ। এ ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দারা। শিগগিরই সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া ইউনিফর্ম প্রস্তুতকারী কারখানার ব্যাংক হিসাব তলবসহ সার্বিক কার্যক্রম খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, পাহাড় নিয়ে বারবার যেসব বিষয় আলোচিত হচ্ছিল, সেগুলোর আলামত স্পষ্ট হচ্ছে। নিরাপত্তার জন্য এটা একটা আশঙ্কার বিষয়। কারণ আমাদের দেশের কুকিরা আশপাশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে জড়িয়ে কোনো কিছু করার চেষ্টা করতে পারে। তিনি বলেন, কুকি-চিন দুই কোটি টাকার ইউনিফর্মের অর্ডার করেছিল। তার মানে হচ্ছে, তাদের বড়সড় অর্থের জোগান রয়েছে। শহরের এত ভেতরে এসে এতগুলো কাপড় বানাতে আসার বিষয়টিও খারাপ সিগন্যাল দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এরা আরাকান আর্মির মতো একটা পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টায় থাকবে। তাদের অর্থের জোগান কারা দিচ্ছে খতিয়ে দেখতে হবে। তাদের নিরাপদ অঞ্চল তৈরি করতে দেওয়া যাবে না।
জানান গেছে, তিন বছর আগে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ। সে সময় ফেসবুকে দুই পার্বত্য জেলা
রাঙামাটি ও বান্দরবানের মোট নয়টি উপজেলার সমন্বয়ে ‘স্বশাসিত বা স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতাসহ’ পৃথক রাজ্যের দাবি তোলে তারা। উপজেলাগুলো হলো রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম। এই উপজেলাগুলো মিয়ানমার ও ভারতের মিজোরামের সীমান্তবর্তী। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে তারা। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে আতঙ্কে সেই সময় ভারতের মিজোরামে পালিয়ে আশ্রয় নেয় কেএনএফ সদস্যদের একটি বড় অংশ।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে র্যাব জানায়, সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়। এর পর ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে জঙ্গি এবং কেএনএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলার অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। পরে থানচি উপজেলাতেও অভিযান চালানো হয়। এই অভিযান চালাতে গিয়ে নিহত হন সেনাবাহিনীর বেশকিছু সদস্য। সংঘাতে প্রাণ যায় কেএএনএফ সদস্যেরও। এ অবস্থার মধ্যে সশস্ত্র ওই গোষ্ঠীর সঙ্গে ‘শান্তি আলোচনা’ শুরু করে প্রশাসন। তখন মুক্তির আশা জাগতে শুরু করেছিল পাহাড়ের মানুষের মনে। কিন্তু শান্তি আলোচনার মধ্যেই গত বছরের এপ্রিলে ১৬ ঘণ্টার ব্যবধানে বান্দরবানের তিনটি ব্যাংক শাখায় হামলা ও ডাকাতির ঘটনা ঘটে। তারা ভরদুপুরে বান্দরবানের রুমা এবং থানচি উপজেলার কৃষি ও সোনালী ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা চালায়। সশস্ত্র কেএনএফ সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের আটটি চাইনিজ রাইফেল, দুইটি এসএমজি এবং ৩৮০টি গুলি লুটে নিয়ে যায়। এ ছাড়া আনসারদের চারটি শটগান ও ৩৪টি গুলি লুট করে। একজন ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণও করে। এ ঘটনার পর পাহাড়ে নতুন করে আতঙ্ক শুরু হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আবার জোরদার অভিযান শুরু করে কেএনএফের বিরুদ্ধে। এই অভিযানের মুখে টিকতে না পেরে কেএনএফ সদস্যদের অনেকেই সীমান্ত পেরিয়ে মিজোরাম ও মিয়ানমার পালিয়ে যায়।
এদিকে, চট্টগ্রাম নগরীর নয়ারহাটের রিংভো অ্যাপারেলস থেকে কেএনএফের ২০ হাজার ৩০০ ইউনিফর্ম জব্দের ঘটনায় নতুন করে সশস্ত্র এই গোষ্ঠী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দেখা দেয়। ইউনিফর্মগুলো দুই কোটি টাকার চুক্তিতে তৈরি করছিল পোশাক কারখানাটি। এ মাসেই সেগুলো সরবরাহ করার কথা ছিল। এ ঘটনায় পোশাক কারখানার মালিকসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা হলেনÑ সাহেদুল ইসলাম, গোলাম আজম ও নিয়াজ হায়দার। সাহেদুল কারখানার মালিক। গত মার্চে পোশাকগুলো কারখানাটিতে ফরমাশ দিয়েছিলেন গোলাম আজম ও নিয়াজ হায়দার। তারা মংহলাসিন মারমা ওরফে মং নামে একজনের কাছ থেকে দুই কোটি টাকা চুক্তিতে পোশাকগুলো তৈরির ফরমাশ নেন। ইউনিফর্ম উদ্ধারের ঘটনায় গত ১৮ মে বায়েজিদ বোস্তামী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করে পুলিশ। মামলায় গ্রেপ্তার তিনজন ছাড়াও রাঙামাটির কাপ্তাইয়ের মংহলাসিন মারমাকে (৩৭) আসামি করা হয়।
মামলা তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা ইতোমধ্যে গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন। অর্থের জোগানদাতাদের খোঁজা হচ্ছে। এ ছাড়া কেএনএফ কেন এক সঙ্গে এত ইউনিফর্ম তৈরি করছিল তার কারণও খুঁজছেন। এ নিয়ে নানামুখী তদন্ত শুরু হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি র্যাব ও সেনাবাহিনী বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। পাহাড়ের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বিগ্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
গতকাল সেনানিবাসে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশন্সের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উল-দৌলা সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, চট্টগ্রামের একটি কারখানায় ২০ হাজার ৩০০ ইউনিফর্ম উদ্ধারের ঘটনা ভালো কোনো খবর নয়। এ পোশাক কাদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল, সেটা আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। এটা নিয়ে কাজ চলছে। এ বিষয়টি দেশের নিরাপত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিষয়টিকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে নিয়েছি।
অন্যদিকে গত বছর ব্যাংক ডাকাতির ঘটনার পর জানা গিয়েছিল কেএনএফের সামরিক শাখায় চার শতাধিক সদস্য রয়েছে। কিন্তু ২০ হাজার ৩০০টি ইউনিফর্ম জব্দের ঘটনায় সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যার প্রশ্নটিও তদন্তে গুরুত্ব দিচ্ছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এ ছাড়া ওই সময় জানা গিয়েছিল, কেএনএফের অস্ত্রভাণ্ডারে এসএমজি, চায়নিজ রাইফেল, একে-৪৭, বার্মিজ একনলা বন্দুকসহ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে তিন শর বেশি। পার্বত্য চট্টগ্রামের রুমা, থানচি, রোয়াংছড়িসহ গহিন অরণ্যে তাদের বিচরণ। রাঙামাটির বিলাইছড়ির পাশাপাশি মিয়ানমার ও ভারতের মিজোরাম সীমান্তবর্তী এলাকায় রয়েছে তাদের গোপন ঘাঁটি।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম