সংকটকালের চিন্তা
আবুল মোমেন : কবি, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক, দৈনিক আমাদের সময়
দেশ সংকটের মধ্যেই রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার সংকট উত্তরণের কাজ করে যাচ্ছে। সর্বশেষ ধাক্কাটি আপাতত সামলানো গেলেও নির্বাচন পর্যন্ত পরিস্থিতি কেমন থাকবে তা অনুমান করার মতো পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি। প্রধান উপদেষ্টা এই সরকারের দায়িত্বগ্রহণের সময়ই বলেছিলেন যে, তিনি রাজনীতির লোক নন, সরকার পরিচালনা তার কাজ নয়। তবে অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের অনুরোধে বিপুল ত্যাগের বিনিময়ে রাষ্ট্রগঠনের যে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তা যেন হাতছাড়া না হয়, সে জন্য কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্যপূরণে দায়িত্বগ্রহণে সম্মত হয়েছেন। তার এবং সংশ্লিষ্ট অন্যদের আলোচনায় এটা স্পষ্ট যে অন্তর্বর্তী সরকারের মূল কাজ তিনটি- বিগত স্বৈরশাসনের সময়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষাপূরণে রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার সাধন এবং একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান।
লক্ষ্য বা কাজ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই, কিন্তু কাজ কতটা এবং কত দিনে হবে এ নিয়ে মতপার্থক্য যথেষ্ট। এটা কোনো অস্বাভাবিক বাস্তবতা নয়। কারণ সংস্কার এবং বিচার শুরু করা যত সহজ তা সম্পন্ন করা সময়সাপেক্ষ। সবাই জানি যে অন্তর্বর্তী
সরকারের মেয়াদ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। মনে পড়ছে গত বছর সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, তার সরকারের মেয়াদ কতটা হতে পারে বলে আমরা মনে করি। তখনকার প্রেক্ষাপটে কিছুটা আলোচনার পর বলা হয়েছিল সর্বোচ্চ দুই বছর হতে পারে। কিন্তু তার পরের ৭/৮ মাসের ঘটনাবলিতে মনে হচ্ছে তার সরকারের জন্য অতটা সময় নির্বাচন পেছানো সম্ভব হবে না, ঠিকও হবে না। বরং মনে হয় তাকে ও তার সরকারকে নির্বাচনের বিষয়ে আরও জরুরি ভিত্তিতেই ভাবতে হবে।
ডিসেম্বরের বিষয়টা বারবার উঠে আসছে এ জন্যে যে এর চেয়ে পেছালে বড়জোর জানুয়ারিতে যাওয়াই সম্ভব। কারণ ২০২৬-এ রোজা শুরু হবে ফেব্রুয়ারি থেকে। সে মাস থেকেই এসএসসি পরীক্ষাও শুরু হওয়ার কথা। ঈদের পর এইচএসসি পরীক্ষাও থাকবে। সাধারণত এপ্রিল-মে’র গরম ও কালবৈশাখীর কারণে এ সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। তা ছাড়া মে মাসের শেষদিকে কোরবানির ঈদও থাকবে। আর ইদানীং জুনের মাঝামাঝি থেকেই বৃষ্টি শুরু হচ্ছে, অনেক সময় পাহাড় থেকে নামা আকস্মিক ঢলের বন্যার আশঙ্কাও থাকে। ফলে নির্বাচন আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে না হলে একেবারে আগামী বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকছে। এতে এনসিপি ও জামায়াত আপত্তি না করলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতও বাড়ে কি না সে সংশয় থেকে যাবে। তদুপরি বিএনপির আপত্তি তো থাকছেই। সব মিলিয়ে এখনকার পরিস্থিতিতে নির্বাচন পেছালে অস্থিরতা ও সংঘাত বাড়ার আশঙ্কাই দেখা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
নির্বাচনের অপেক্ষা আরও দীর্ঘায়িত করার ক্ষেত্রে সমস্যার আরও কারণ হলো গত নয় মাসে সরকার বা অনেক উপদেষ্টা নানা রূপ সমালোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। আবার সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েও সমাজে নানা মহল নানা উদ্দেশ্যে অস্থির ও অস্থিতিশীল সময়কে কাজে লাগাচ্ছে। তার আলামত সামাজিক মাধ্যমে পাওয়া যায়। বর্তমান বাস্তবতায় আইনের মাধ্যমে এগুলো বন্ধ করাও কঠিন। সেই সঙ্গে ছাত্রদের রাজনৈতিক সংগঠন এনসিপির প্রতি সরকারের সহানুভূতি খুব একটা অস্পষ্ট নয়। এ অবস্থায় তাদের পক্ষেও জনসমর্থন ধরে রাখা কঠিন হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জনসভার বক্তৃতায় একপর্যায়ে প্রধান উপদেষ্টার বিকল্প খোঁজার কথা বললেও সবাই জানি যে ড. ইউনূসের উপযুক্ত বিকল্প পাওয়া সহজ হবে না। যা-ই হোক, বিএনপিও বাস্তবতা বুঝেই অবস্থান পাল্টে নিয়েছে এর মধ্যে। বিএনপিসহ তিনটি দলের প্রতিনিধিরা তার সঙ্গে দেখা করে দায়িত্ব পালনে তাকে সহযোগিতার আশ^াস দিয়েছেন। বিএনপি নির্বাচনের ব্যাপারে ডিসেম্বরের পরে যেতে রাজি নয় আর জামায়াত ও এনসিপি এক্ষেত্রে নমনীয় অবস্থানেই থাকছে। তাতে হয়তো উপদেষ্টারা তাদের নিয়ে স্বস্তিতে আছেন। তবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বুঝতে হবে আলোচনার মাধ্যমে যে স্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে তা খুব পোক্ত কিছু নয়, সহজেই এ আবরণ ছিন্ন হতে পারে। ফলে সতর্কতার সঙ্গে জরুরি সংস্কারগুলো দ্রুত সম্পন্ন করে নির্বাচনের দিকে যেতে হবে। বিচার প্রক্রিয়া চলমান থাকবে এবং তা ব্যাহত হবে না এমন অঙ্গীকার নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব পক্ষের কাছ থেকেই নিতে হবে।
অতীতে সৃষ্ট সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থতার কারণ থেকেও সংশ্লিষ্ট সবার শিক্ষা নেওয়া দরকার। দেখা গেছে সরকার পতনের আন্দোলনে যত সহজে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত ও কার্যকর হয়, তা সাফল্যের পরে আর থাকে না। ঐক্য রক্ষার কথা সব দল বললেও এর উপযোগী অঙ্গীকার, কর্মতালিকা, কাজের অগ্রাধিকার, অন্তত এর খসড়া তো আন্দোলনের পরপর দলগুলোর বৈঠকের মধ্য দিয়েই প্রণীত হতে পারত। ৫ আগস্টের পরে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন পর্যন্ত সময়টুকুতে অভ্যুত্থানকারী ছাত্র নেতৃত্ব কেবল কি সরকার গঠনেই ব্যস্ত ছিল? তখনই তো তারা সমমনা কিছু বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিয়ে বিভিন্ন গ্রুপে বসে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাদের ঘোষণা (বা সনদ), অগ্রাধিকার কার্যক্রম ও নির্বাচনের রূপরেখার খসড়া প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে পারত। অন্যান্য দলের সঙ্গে পরবর্তী সময়ে এসব খসড়াকে আলোচনার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা যেত। কাজ এগিয়ে রাখলেই পরিকল্পনা অনুযায়ী সে কাজ করা যায়। এখন বিএনপি নির্বাচন ব্যতীত আর কিছুই ভাবছে না বলে মনে হয়। তাদের ভোটার-সমর্থকদের মনেও নির্বাচন এবং ক্ষমতার চিন্তা ভালোই ঘুরপাক খাচ্ছে। ফলে অন্যান্য দলের পক্ষে এক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা সম্ভব হবে না। মনে রাখতে হবে মূল তিন কাজের মধ্যে একমাত্র সুষ্ঠু নির্বাচনই দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব। সংস্কার ও বিচার দুটোই দীর্ঘমেয়াদি কাজ। তবে এ বিষয়ে এটিই শেষ কথা নয়। কারণ জনদাবির মধ্যে রয়েছে ‘গণতান্ত্রিক’ স্বৈরশাসনের পুনরাবির্ভাব যেন না ঘটে তার কার্যকর ব্যবস্থা। ফলে সংস্কার কিছু না করে নির্বাচনেও যাওয়া যাবে না। সেটা কেবল অভ্যুত্থান নয়, জনপ্রত্যাশারও বরখেলাপ হবে।
ফলে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক ঐকমত্যের একটা রূপরেখা দাঁড়ানো দরকার। বিভিন্ন দলের সঙ্গে সরকারের নির্ধারিত কমিটির এক দফা বৈঠক শেষ হয়েছে। এর জন্যে ঐকমত্য কমিশন দ্বিতীয় দফা বৈঠক করবেন বলেও জানিয়েছেন। আমাদের মনে হয় এ ধরনের বৈঠকের মাধ্যমে বিভিন্ন ইস্যুতে একটা ঐকমত্যের সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সহজ হবে না। এমনকি এ আলোচনা ফলপ্রসূ নাও হতে পারে। বরং জরুরি প্রয়োজনীয় আরও করণীয় বিষয়গুলোর ভিত্তিতে ঐকমত্য কমিশনই একটি খসড়া রূপরেখা দাঁড় করিয়ে তার ভিত্তিতে আলোচনা করলে সমাধানে পৌঁছানো সহজ হবে বলে মনে হয়।
এ কথাও বলতে হবে যে অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের অনেকেই তাদের দলীয় এবং ব্যক্তিগত নানা বক্তব্য ও কাজের মাধ্যমে জনমনে যেমন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, তেমনি তাদের জনপ্রিয়তাকেও মলিন করেছে। ফলে তাদের পক্ষে জুলাইয়ের মতো গণজাগরণের পুনরাবৃত্তি সম্ভব কি না, তাও প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে পড়েছে। ভুল সিদ্ধান্ত নিজেদের ও দেশের ক্ষতি করতে পারে। পারে চলমান অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তুলতে। এতে তাদের রাজনৈতিক অভিযাত্রাও কঠিন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আদতে এ হলো সব মহলের সর্বোচ্চ সংযমের সময়, সতর্ক থাকার সময় এবং বিবেচনাবোধ প্রয়োগে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দেখানোর সময়। বড় দল হিসেবে এক্ষেত্রে বিএনপিকে সবার চেয়ে এগিয়ে থাকতে হবে। একই সঙ্গে অভ্যুত্থানের বর্তিকাবাহক হিসেবে এনসিপিকে লক্ষ্যপূরণে সংযম ও সাহসের, বিবেচনা ও দূরদর্শিতার, আন্তরিকতা ও ঔদার্যের সমন্বয় ঘটাতে হবে। এসব ক্ষেত্রে ঘাটতি রেখে বর্তমান সমস্যার সমাধান ও দেশকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
আবুল মোমেন : কবি, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক, দৈনিক আমাদের সময়
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন