ট্রাম্প প্রশাসনের বাণিজ্যনীতি বাংলাদেশের করণীয়
সমস্যার সূত্রপাত
মার্কিন প্রসিডেন্টকে ১৯৭০ সালে প্রদেয় ‘জাতীয় অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা’ সম্পর্কিত বিশেষ ক্ষমতাবলে চলতি ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসের ২ তারিখ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর বিভিন্ন হারে পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি পণ্যের ওপর যেসব দেশ অন্যায্যভাবে শুল্ক আরোপ করে থাকে এবং যেসব দেশে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকৃত পণ্য বিভিন্ন অ-শুল্ক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়, সেসব দেশকে মোকাবিলা করার জন্য পাল্টা শুল্ক আরোপ করার অধিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আছে। সব দেশের জন্য ন্যূনতম পাল্টা শুল্ক নির্ধারণ করা হয় ১০ শতাংশ এবং এর বাইরে ৫৭টি দেশের ওপর বিভিন্ন মাত্রায় অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক নির্ধারণ করা হয় ৩৭ শতাংশ। তবে ৯ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পাল্টা শুল্কের কার্যকারিতা তিন মাসের জন্য ‘স্থগিত’ ঘোষণা করেন এবং এ সময়কালে সব দেশের জন্য ১০ শতাংশ হারে অতিরিক্ত আমদানি শুল্ক প্রযোজ্য হবে বলে ঘোষণা দেন। যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এপ্রিল ২ তারিখকে ‘লিবারেশন ডে’ হিসেবে অভিহিত করেন, তার এ ধরনের সিদ্ধান্ত ছিল একতরফা এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নীতিমালা ও শৃঙ্খলার পরিপন্থি।
পাল্টা (অতিরিক্ত) শুল্কহার নির্ধারণ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য খাতে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণকে সে দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিমূল্যকে ভাগ দিয়ে (শতাংশ হিসেবে)। প্রাথমিক পর্যায়ে এ ফর্মুলা অনুসারে যে আমদানি শুল্ক হিসাব করা হয়, তার অর্ধেক পরিমাণ পাল্টা শুল্ক হার হিসাবে আরোপ করা হবে বলে ঘোষণায় বলা হয়। যেমন, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি ছিল ৮.৬ বিলিয়ন ডলার; এ সময়ে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি ছিল ২.২ বিলিয়ন ডলার। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ৬.৪ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক দাঁড়ায় ৭৪ শতাংশ (বাণিজ্য ঘাটতি ভাগ আমদানিমূল্য, শতাংশ হিসাবে)। এর ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের জন্য অতিরিক্ত পাল্টা শুল্কহার নির্ধারণ করা হয় ৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ চলমান গড় ১৫.২% শুল্কের সঙ্গে যোগ করলে তা দাঁড়ায় ৫২.২%।
সব দেশের জন্যই একক একটি ফর্মুলা প্রয়োগের মাধ্যমে পাল্টা শুল্ক নির্ধারণ যে কোনো বিচারেই একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি ও অসন্তুষ্টির যদি কারণ থেকেও থাকে তা দেশভেদে ভিন্নতর হওয়ার কথা, তাই একটি অভিন্ন ফর্মুলা প্রয়োগের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। যেমনÑ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য খাতের বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত আছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ন্যূনতম ১০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্কহার যুক্তরাজ্যের ওপরও আরোপ করা হয়। যেমন করা হয়েছে, জনমানববিহীন হার্ড অ্যান্ড ম্যাকডোনাল্ড দ্বীপের ওপর! এটাও উল্লেখ্য যে, অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে কেবল পণ্য খাত বিবেচনা করা হয়েছে; সেবা খাত বাণিজ্যকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বৈশ্বিক বাণিজ্যে ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি ছিল ১২০০ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু একই সময়ে সেবা খাতে বৈশ্বিক বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বৃত্ত ছিল ২৯৫ বিলিয়ন ডলার (যা ২০০০ সালে ছিল ৭৭ বিলিয়ন ডলার)। কিন্তু পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় সেবা খাত বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যে উদ্বৃত্ত আছে, সে তথ্যকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। প্রশ্ন থেকে যায়, যেসব দেশের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সেবা খাতের বাণিজ্যে ঘাটতি আছে, তারাও যদি যুক্তরাষ্ট্রের অনুরূপ পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে বিশ্ব বাণিজ্য পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে?
বর্তমানে ৯০ দিনের জন্য (৯ এপ্রিল থেকে ৮ জুলাই, ২০২৫) সব দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপিত থাকবে। অর্থাৎ তিন মাসের জন্য বাংলাদেশের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপিত হবে গড়ে ২৫.২ (১৫.২%+১০%) শতাংশ হারে। চীনের ওপর অবশ্য ১৪৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক বলবৎ থাকবে (চীনও অবশ্য তার ওপর প্রযোজ্য শুল্কের উত্তরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর ১২৫ শতাংশ পাল্টাপাল্টি অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে)।
প্রস্তাবিত পাল্টা শুল্ক আরোপ হলে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি গুরুত্বভারীত্ব গড় শুল্কহার আগের ৩% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াত ২৮%-এ! তিন মাসের জন্য প্রস্তাবিত ১০% অতিরিক্ত আমদানি শুল্কহার প্রয়োগ করলে তা দাঁড়াবে ১৩%। প্রকৃত অর্থে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এ ধরনের উচ্চ শুল্কহার অন্তত গত ৭৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
সম্ভাব্য অভিঘাতগুলো
এ ধরনের সংরক্ষণমূলক পদক্ষেপের ফল কী হতে পারে, তার কিছুটা ধারণা অবশ্য পাওয়া যায় ইতিহাস থেকে। ১৯৩০ সালে স্মুট-হওলি অ্যাক্টের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনেরই শুল্ক দেয়াল নির্মাণ করেছিল। এর ফলে ১৯২৯ সালের শেয়ার মার্কেট ধসের পর যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে, তা প্রলম্বিত হয়েছিল। উনিশ শতকের ত্রিশের দশকের অর্থনৈতিক মহামন্দার জন্য অনেক অর্থনীতিবিদই এই অ্যাক্টকে দায়ী করেন। এ কথাও সুবিদিত যে, এ তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে এবং পরে মুক্তবাণিজ্য উদারীকরণের পক্ষে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু হওয়া গ্যাট আলোচনা ও ১৯৯৫ সালে বিশ্ববাণিজ্য প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। পৃথিবীর যে কয়েকটি দেশ গত পাঁচ দশকের বাণিজ্য উদারীকরণ ও অপেক্ষাকৃত মুক্ত বিশ্ববাণিজ্যের সুবাদে লাভবান হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ছিল তার মধ্যে অন্যতমÑ ২০০৮ সালে ইউরোজোন অর্থনীতি ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির আকার ছিল প্রায় সমান; ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির আকার দাঁড়ায় ইউরোজোনের দ্বিগুণ। ৩০ বছর আগে জাপানের মাথাপিছু আয় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিগুণ, আর ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু আয় ছিল জাপানের দেড়গুণেরও বেশি। সুতরাং চলমান বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের আর্থসামাজিক উন্নয়নের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে তা কোনোভাবেই বলা যাবে না। বিভিন্ন বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, এ ধরনের অতিউচ্চ পাল্টা আমদানি শুল্ক আরোপের ফলে মার্কিন অর্থনীতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও হ্রাসকৃত চাহিদা, উচ্চ উৎপাদন ব্যয় ও নিম্ন বিনিয়োগ হার এবং এর ফলে নিম্ন প্রবৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির এমন একটি দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা একেবারে অমূলক নয়। প্রকৃত বিচারে ভোক্তা ও উৎপাদকের ওপর বাড়তি আমদানি শুল্ক কী ধরনের মূল্যচাপ সৃষ্টি করবে, তা অবশ্য নির্ভর করবে শুল্কের মূল্য সংবেদনশীলতা, আর অন্যদিকে চাহিদার মূল্য সংবেদনশীলতার ওপর। ব্র্যান্ড-বায়াররা চেষ্টা করবে উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের কাঁধে উচ্চ শুল্কের পূর্ণ বা একটি অংশ চাপিয়ে দিতে। ভোক্তারা চাহিদা সংকোচন করে মূল্যবৃদ্ধির উত্তর দিতে পারে, এ আশঙ্কায় তাদের চেষ্টা থাকবে ভোক্তা পর্যায়ে শুল্কের প্রভাব যতটা সম্ভব কম রাখা, যাতে চাহিদার ওপর আনুপাতিকভাবে কম প্রভাব পড়ে। ইতোমধ্যে ব্র্যান্ড-বায়াররা বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের ডিসকাউন্টে তৈরি পোশাক বিক্রয় করার জন্য চাপ দিচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। এ ধরনের শুল্ক আরোপের ফলে যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে, তার অভিঘাত বিশ্ববাণিজ্য ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সুতরাং পাল্টা শুল্ক আরোপের নেতিবাচক অভিঘাত শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং তা বৈশ্বিক বাণিজ্য-বিনিয়োগেও বিরূপ প্রভাব ফেলবে এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এর নেতিবাচক অভিঘাতের আশঙ্কা আছে। ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন দেশ ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের কৌশল নির্ধারণে সচেষ্ট হয়েছে। মূলত এ ক্ষেত্রে তিন ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয়। চীন ও কানাডার মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষ পাল্টা শুল্কের বিপরীতে প্রতিশোধমূলক (রিটালিয়েটারি) শুল্ক আরোপ করে জবাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইসরায়েলসহ বেশ কয়েকটি দেশ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক শূন্যে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছে। ৭০টির বেশি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে; ইতোমধ্যে অনেক দেশ (বাংলাদেশের মতো) যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু করে দিয়েছে। অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসন ইতোমধ্যে চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু করেছে এবং ট্রাম্প বলেছেন, আলোচনা ফলপ্রসূ হচ্ছে। সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী (১২ মে, ২০২৫), যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর আরোপিত শুল্কহার ১৪৫% থেকে ৩৫%-এ নামিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছে। অন্যদিকে চীন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আরোপিত শুল্ক ১২৫% থেকে ১০%-এ হ্রাস করতে স্বীকৃত হয়েছে। এ সমঝোতা ৯০ দিনের জন্য কার্যকর হবে এবং আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও শুল্ক কাঠামো
বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০২৪ সালে ২ হাজার ৫১৫টি পণ্য আমদানি করে। এগুলোর মধ্যে ২৯৭টির ওপর বাংলাদেশে কোনো আমদানি শুল্ক নেই; এ ধরনের পণ্যের আমদানির পরিমাণ ছিল ৭৫৭.৩ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক-চতুর্থাংশের বেশি আমিদানিতে কোনো শুল্ক ছিল না। বাকি ২ হাজার ২১৮টি পণ্যের ওপর বিভিন্ন মাত্রায় শুল্ক আছে, যার মধ্যে ৭৮২টি পণ্যের ওপর শুল্ক ২০ শতাংশের কমÑ এ ধরনের পণ্যের মোট আমদানির পরিমাণ ১ হাজার ৯২০.৬ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২৪ সালে এসব পণ্য থেকে মোট শুল্ক আদায় হয়েছে ৮৫.৫ মিলিয়ন ডলার। ১ হাজার ৫৩৬টি পণ্যের ওপর শুল্কহার ছিল ২১ শতাংশের বেশি; যেসব পণ্যের মোট আমদানি মূল্য ছিল ৩৭১.০ মিলিয়ন ডলার এবং মোট আরোপিত আমদানি শুল্কের পরিমাণ ছিল ৯৫.০ মিলিয়ন ডলার।
সুবিদিত যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের একক বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্যস্থান। যুক্তরাষ্ট্রের হিসাব মতে, ২০২৪ সালে সে দেশে বাংলাদেশ থেকে আমদানি হয়েছে ৮৬০ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৯১ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে (শুল্ক, পরিবহন খরচ, ইন্স্যুরেন্স ইত্যাদির কারণে দুই দেশের আমদানি-রপ্তানির হিসাবে কিছু পার্থক্য আছে)। বাংলাদেশে এ আমদানির মধ্যে ৭৫ কোটি ডলারের পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় এসেছে। বাকি ২১৬ কোটি ডলারের আমদানির বিপরীতে বাংলাদেশে মার্কিন পণ্যের ওপর ১৮ কোটি ডলার শুল্ক আদায় করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া ৮৪৫ কোটি ডলার পণ্যের মধ্যে ৪০ কোটি ডলারের পণ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধা পেয়েছে; বাকি ৮০৫ কোটি ডলারের পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ১২৭ কোটি ডলার আমদানি শুল্ক আদায় হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানির ওপর যে শুল্ক আদায় করেছিল, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর তার চেয়ে ৭ গুণ বেশি শুল্ক আদায় করেছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর আমদানি গুরুত্ব ভারিত গড় শুল্কহার ছিল ৬.২ শতাংশ। যদি আদায়কৃত শুল্ক থেকে আমদানিকারকদের ফেরতযোগ্য শুল্ক বাদ দেওয়া হয় (যেমনÑ আগাম ভ্যাট, আগাম আয়কর ইত্যাদি), তা হলে এ গড় শুল্কহার হবে মাত্র ২.২ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর আমদানি গুরুত্ব ভারিত গড় শুল্কহার এ সময়কালে ছিল ১৫.২ শতাংশ; তৈরি পোশাক, যার অবদান মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৯০ শতাংশের কাছাকাছি, তার ওপর আরোপিত গড় শুল্কহার ছিল ১৬.০ শতাংশ। তাই অবশ্যই বলা যায়, বাংলাদেশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তুলনামূলকভাবে বেশি সহজ শর্তে বাজার সুবিধা দিচ্ছে; বিপরীতটি ঠিক নয়। এ কারণে বাংলাদেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ অন্যায্য ও অযৌক্তিক।
বাংলাদেশের সম্ভাব্য কৌশল
ট্রাম্পের অনুসৃত শুল্কনীতির কারণে যে নেতিবাচক অভিঘাত বাংলাদেশের বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে পড়তে পারে এবং যে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তা মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সুচিন্তিত কৌশল অবলম্বন করতে হবে। পাল্টা শুল্ক আরোপের অব্যবহিত পরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে কিছু প্রস্তাব এবং আরোপিত পাল্টা শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিতের অনুরোধসহ একটি পত্র প্রেরণ করেন। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) অফিসে পত্র পাঠিয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা অবহিত করেন যে, বাংলাদেশের শুল্ক তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে বর্তমানে আমদানিকৃত ১৯০টি পণ্যের ওপর বর্তমানে কোনো শুল্ক নেই এবং এর বাইরে বাংলাদেশ আরও ১০০টি আমদানিকৃত পণ্যকে শুল্কমুক্ত তালিকায় যুক্ত করার চিন্তাভাবনা করছে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আমদানি হওয়া প্রধানতম তিনটি পণ্য (স্ক্র্যাপ, এলপিজির উপাদান বিউটেনস এলপিজি ও প্রোপেন) থেকে গত বছর ৬ কোটি ১৬ লাখ ডলার শুল্ক আদায় হয়েছে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, এসব পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধা প্রদান করতে হলে অন্য দেশের জন্যও সেটি সমানভাবে প্রয়োগ করতে হতে হবে (এমএফএন বা মোস্ট ফেভারড নেশান নিয়ম অনুসারে)। ফলে এ তিন পণ্যে বাংলাদেশকে মোট ১৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারের শুল্ক ছাড় দিতে হবে, যা দেশীয় মুদ্রায় ২ হাজার ৫০ কোটি টাকার সমান। অন্যান্য পণ্যেও যুক্তরাষ্ট্রকে শূন্য শুল্ক সুবিধা প্রদান করলে শুল্ক ছাড়ের এ অংক আরও বাড়বে। যেমন, যদি গ্যাস টারবাইন, সেমি কন্ডাক্টর ও মেডিক্যাল ইকুইপমেন্টের আমদানির ক্ষেত্রেও শূন্য শুল্ক সুবিধা প্রদান করা হয় ও অন্য সব দেশের থেকে এসব পণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে একই ধরনের শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রযোজ্য হলে এ তিন পণ্যে মোট শুল্ক ছাড় দিতে হবে ১১.৭ কোটি ডলার বা ১ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। সুতরাং কোন পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে কোন ধরনের শুল্ক সুবিধার প্রস্তাব দেওয়া হবে, সে সিদ্ধান্ত সবদিক বিবেচনা করেই নিতে হবে।
এ ধরনের রাজস্ব ক্ষতি এড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করার কথা বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করতে পারে। এফটিএ হলে অন্য দেশের থেকে সমজাতীয় পণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সেসব দেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুরূপ শুল্ক সুবিধা, অর্থাৎ সমপরিমাণ শুল্ক ছাড় দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকবে না। স্মর্তব্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোস্টারিকা, ডমিনিকান রিপাবলিক, বাহরাইন, জর্ডানসহ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের দ্বিপাক্ষিক এফটিএ আছে। এসব দেশের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফটিএ চুক্তি সাধনের বিষয়টি বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফটিএ সম্পাদন করলে তা ভারত ও চীনের সঙ্গে এফটিএ করার চেয়ে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের জন্য বেশি সুবিধাজনক হবে। এর কারণ হলো, যেখানে শেষের দুটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বড় আকারের বাণিজ্য ঘাটতি আছে (যথাক্রমে ১২ বিলিয়ন ও ১৬ বিলিয়ন ডলার), সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত আছে (৬.৪ বিলিয়ন ডলার)। এ কারণে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র এফটিএর পরে পরস্পরকে শূন্য শুল্ক বাজার দিতে সুবিধা প্রদান করলে বাংলাদেশের শুল্ক ছাড় হবে তুলনামূলকভাবে কম, আর অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক ছাড় থেকে বাংলাদেশের লাভ হবে তুলনামূলকভাবে বেশি, যার সুবাদে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। চীন ও ভারতের সঙ্গে এফটিএ করা হলে ও পারস্পরিক শূন্য শুল্ক সুবিধা প্রদান করা হলে বাংলাদেশের বড় ধরনের আমদানি শুল্ক ছাড় দিতে হবে। কিন্তু বিপরীতে যেহেতু এ দুই দেশেই বাংলাদেশের রপ্তানি অনেক কম, সে কারণে শূন্য শুল্কপ্রাপ্তির সুবিধা হবে অনেকটাই সীমিত। আর বর্তমানে এ দুই দেশই বাংলাদেশকে প্রায় সব পণ্যে শূন্য শুল্ক সুবিধা দিচ্ছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, তবে এটাও ঠিক যে, কেবল শুল্ক ছাড় বিবেচনায় নিয়ে এফটিএর লাভ-ক্ষতি হিসাব করা ঠিক হবে না। মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ইতিবাচক দিকসমূহ ও ঝুঁকি সম্ভাব্য লাভ-ক্ষতি গভীরতর ও বহুমাত্রিক বিশ্লেষণের দাবি রাখে এবং এ হিসাব বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বিদ্যমান ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ-অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাগুলো বিবেচনায় নিয়ে এবং সুনির্দিষ্টভাবে ও দেশভিত্তিকভাবে করতে হবে।
চীনের ওপর ১৪৫.০% শুল্ক আরোপিত হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাংলাদেশ সে বাজারের বড় অংশ দখল করতে সক্ষম হবেÑ এমন ধারণা করা যুক্তিসঙ্গত হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের কৃত্রিম তন্তুনির্ভর তৈরি পোশাকের চাহিদা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। গত এক দশকে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের তুলানির্ভর তৈরি পোশাকের রপ্তানি ৭৫ শতাংশ থেকে ৬৩ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে, যেখানে চীনের অনুরূপ রপ্তানি ৪৭ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ১৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে; ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে তা ৫৮ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ৩৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। উত্তরোত্তর বৃদ্ধিমান চাহিদার প্রেক্ষাপটে এ সময়কালে দেশ দুটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কৃত্রিম তন্তুভিত্তিক তৈরি পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যেহেতু কৃত্রিম তন্তুভিত্তিক তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বর্তমানে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে আছে, সুতরাং শুল্ক পার্থক্যের কারণে চীন ও ভিয়েতনামের তুলনায় মার্কিন বাজারে এ পণ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আছে। তবে তুলানির্ভর যেসব তৈরি পোশাক পণ্যে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে, সেসব পণ্যে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা প্রযোজ্য আমদানি শুল্কহারের পার্থক্যের সুবাদে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
আরেকটি বিষয় অবশ্য এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। চীনের ওপর ২০১৬ সালে ট্রাম্প প্রশাসন যখন ২৫% অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছিল (যা পরে বাইডেন প্রশাসনও অব্যাহত রেখেছিল), তখন চীন (এবং হংকং) ভিয়েতনামে (এবং সীমিত পরিসরে কম্বোডিয়ায়) তাদের বৈদেশিক বাজারমুখী বিনিয়োগ বহুলাংশে বৃদ্ধি করা শুরু করে। ফলে ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন বাজারে চীনের বৈদেশিক বিনিয়োগনির্ভর রপ্তানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। ধারণা করা যায়, ট্রাম্পের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের প্রেক্ষাপটে, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বৃদ্ধির সুযোগ চীন আরও সক্রিয়ভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করবে এবং এ ধরনের কৌশলের ওপর নির্ভর করে চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অস্বাভাবিক শুল্ক বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় সচেষ্ট হবে।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি শূন্যে নামিয়ে আনতে হলে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রে তার রপ্তানি স্থির রেখে আমদানি বাড়াতে হবে ২৮৪ শতাংশ। বিশ্ববাণিজ্যের প্রেক্ষাপটে এভাবে হিসাব করার অবশ্য কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্কের যৌক্তিকরণ ও আমদানি সহায়ক নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি হয়তো কিছুটা হ্রাস করা সম্ভব এবং বাংলাদেশের রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যের অংশ (যেমনÑ তৈরি পোশাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত তুলার অংশ) সীমিত পরিমাণে হলেও বৃদ্ধি করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে মার্কিন তুলার জন্য বিশেষ ওয়্যারহাউজ নির্মাণের কথা ভাবা যেতে পারে ও বিলম্বিত পরিশোধ সুবিধা প্রদানের কথা ভাবা যেতে পারে। শেষের বিচারে বাংলাদেশের ব্যক্তি খাত, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যের প্রায় সবটাই যারা আমদানি করে থাকে, তাদেরই এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এটাও মনে রাখতে হবে যে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক বাজার সুবিধা দেওয়া হবে এবং অনুরূপ সুবিধা অন্য দেশকেও দেওয়া হবে, তখন অন্যান্য দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকারকদের বাংলাদেশে শুল্কমুক্ত সুবিধাপ্রাপ্তির কারণে প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হবে না।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পাশাপাশি বাংলাদেশকে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করে বাজার ও পণ্য বৈচিত্র্যকরণের জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। চীনের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের পরিপ্রেক্ষিতে আগামীতে বৈদেশিক বিনিয়োগের গন্তব্যস্থল ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার বাইরে সম্প্রসারিত করতে চীনের পক্ষ থেকে আগ্রহ থাকার কথা। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে, যার সুযোগ গ্রহণের লক্ষ্যে চীনের বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বাংলাদেশকে আরও সচেষ্ট ও সক্রিয় হতে হবে। কর্ণফুলী নদীর অপর পারে আনোয়ারায় চীনের জন্য নির্দিষ্ট যে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কথা, তার আশু বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকার ও অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। চীন ৪ এপ্রিল এক সাবমিশানের মাধ্যমে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার বিবাদ নিষ্পত্তি সংস্থায় (ডিএসবি) যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিকÑ এ যুক্তি দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘কনসালটেশন’ চেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ১৭ এপ্রিল তার উত্তরে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থাকে জানিয়েছে, যদিও যুক্তরাষ্ট্র মনে করে না যে, সে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার কোনো বিধান লঙ্ঘন করেছে, তা সত্ত্বেও তারা চীনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে সম্মত আছে। বাংলাদেশের উচিত হবে, এসব আলোচনা কীভাবে অগ্রসর হয়, তার দিকে সতর্ক নজর রাখা ও শুল্কযুদ্ধ কোন পথে অগ্রসর হচ্ছে, তা সক্রিয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা।
এ ধরনের পাল্টা শুল্ক বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে বৈশ্বিক বাণিজ্যকে একটি সর্বসম্মত নীতিমালার আলোকে পরিচালনা করার মূল উদ্দেশ্যকেই নস্যাৎ করে দেবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের মতো অপেক্ষাকৃত দুর্বল সব দেশের জন্য একটি নীতিনির্ভর (রুল-বেইজড) বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থা ‘সবলের খবরদারি আর দুর্বলের ওপর ছড়ি ঘোরানো’ ধরনের বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার তুলনায় (চলমান ব্যবস্থার বিভিন্ন সমালোচনা সত্ত্বেও) অধিকতর শ্রেয়। তাই বাংলাদেশের উচিত হবে অন্য সব দেশের সঙ্গে মিলে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থাকে শক্তিশালী ও কার্যকর করার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখা।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যেসব অশুল্ক বাধার কথা ইউএসটিআর (মার্চ, ২০২৫)-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে তার মধ্যে আছে মেধাস্বত্ব আইনের লঙ্ঘন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা, মার্কিন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক মুনাফা প্রেরণের ক্ষেত্রে সমস্যা, ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতি, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থায় ভর্তুকি সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল না করা, খর্বিত ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, সরকারি ক্রয় কার্যক্রমে স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি। এসব বিষয়ে বাংলাদেশকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে কোনো এফটিএ আলোচনায় এগুলো হবে পূর্বশর্ত। ইতোপূর্বে বাংলাদেশ যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য অঞ্চলবিষয়ক আলোচনা করার কথা উত্থাপন করেছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, এ ধরনের আলোচনার জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের সুবাদে এসব সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ ইতোমধ্যে গৃহীত হয়েছে; কিছু পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন আছে। এ প্রেক্ষাপটে এফটিএর আলোচনা বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক প্ল্যাটফর্ম ‘টিকফা’তে আবার উত্থাপন করা যেতে পারে।
উল্লেখিত পদক্ষেপসমূহ নিতে হবে কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের কারণে নয়, বরং এসব পদক্ষেপ বাংলাদেশকে গ্রহণ করতে হবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন কার্যক্রমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মেধাস্বত্ব আইনের প্রয়োগ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার নিশ্চয়তা বিধান ও সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণের আশু প্রয়োজনীয়তার কারণে এবং সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রাধিকারভিত্তিক চাহিদা ও করণীয়ের নিরিখে। এসব উদ্যোগকে দেখতে হবে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে।
আরও পড়ুন:
ভয়ে লিখব নাকি নির্ভয়ে লিখব
এসব ক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করার মাধ্যমে বাংলাদেশ অনিশ্চিত ও পরিবর্তনশীল ভূ-অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে বাণিজ্য কার্যক্রম পরিচালনায় ঝুঁকি হ্রাসে সমর্থ হবে, সম্ভাব্য সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারবে এবং মধ্যম আয়ের ফাঁদ এড়িয়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণকে টেকসই করতে সক্ষম হবে। ¿
লেখক : সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি