রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন : বাস্তবতা এবং চ্যালেঞ্জ

প্রফেসর ড. এম জসিম উদ্দিন
২৬ মে ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
 রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন : বাস্তবতা এবং চ্যালেঞ্জ

মিয়ানমারের রাখাইনে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী এবং আরাকান আর্মির মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলছে। আরাকান আর্মি রাখাইনের (পূর্বের আরাকান) স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী রাখাইনে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে রাখাইনের নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের খাদ্য এবং ওষুধ সাহায্যের জন্য বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে একটি মানবিক করিডোর স্থাপন করার জন্য জাতিসংঘ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অনুরোধ করেছে। যেহেতু দীর্ঘদিন আমেরিকা রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য দিয়ে এসেছে, এই পরিকল্পনার পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। গত কয়েকদিন ধরে এই মানবিক করিডোর বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা আবং সমালোচনা হচ্ছে, এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। (১) এই মানবিক করিডোরের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা, সম্মানজনক এবং স্থায়ী প্রত্যাবর্তন করা যাবে কি? (২) এই মানবিক করিডোর কি বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে? (৩) এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি এই রকম স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? (৪) এই সংকট উত্তরণে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য একটি জাতীয় ঐক্যমত তৈরি করা যাবে কি?

সত্তর দশকের শেষের দিক থেকে অদ্যাবধি বিভিন্ন সময়ে রাখাইনে জাতি নিধন এবং গণহত্যার কারণে ব্যাপকসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অতীতে রোহিঙ্গাদেরকে ফেরত পাঠানো হলেও, মিয়ানমার সরকারের অসহযোগিতার কারণে, একটি টেকসই এবং স্থায়ী প্রত্যাবর্তন সম্ভব হয়নি। প্রতিবারই মূলত মুসলিম পরিচয়ের কারণে রোহিঙ্গারা নিপীড়নের শিকার হয়ে, সহিংসতার কারণে জীবন বাঁচাতে সামান্য একটু আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছে।  

২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমারের আর্মি দ্বারা ভয়ঙ্করভাবে গণহত্যার শিকার হয়ে ৭ লাখেরও অধিক রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশের তৎকালীন হাসিনা সরকার মানবিক কারণে এই ব্যাপকসংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা এবং জাতীয় নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন কারণে, আগে থেকেই আশ্রয় নেওয়া প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা থাকার পরও আবার নতুন করে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়াটা বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়। কথিত আছে, অবৈধভাবে নির্বাচিত হাসিনা সরকার, পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্বের সমর্থন পাওয়ার জন্য এই ব্যাপকসংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেন।

দীর্ঘ আট বছর ধরে রোহিঙ্গারা একটা নিরাশার মাঝে আছে। সত্যি কথা বলতে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন যেন একটা মিথে পরিণত হয়েছে। আলোর কোনো রেখা দেখা যায়নি গত ৮ বছরে। একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি। প্রচেষ্টা হয়েছিল ২০১৭-এর নভেম্বর মাসে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এবং পরবর্তী সময় চায়নার সহযোগিতায় ত্রিপাক্ষিক আলোচনা, কিন্তু কোনো কিছুই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে পারেনি। রোহিঙ্গারা ফেরত না যাওয়ার পিছনের কারণগুলো আমরা সবাই কম-বেশি জানি; (১) এই চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের ভয়েস প্রতিফলিত হয়নি, প্রত্যাবর্তনের পর তাদের জীবনের নিশ্চয়তা ছিল না। (২) রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানের নিশ্চয়তা ছিল না।

(৩) রোহিঙ্গারা মনে করে, তারা কখনই তাদের ভিটামাটি তথা জন্মস্থানে ফিরে যেতে পারবে না। তাদের জন্য বন্দিশিবিরের জীবনই বরাদ্দ। (৪) রোহিঙ্গারা এই সংকটের প্রধান শিকার এবং তারা বিশ্বাস করে যে, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রাখাইনে একটি ‘সেফ জোন’ প্রতিষ্ঠা ছাড়া রোহিঙ্গাদের নিরাপদে প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়। (৫) রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় স্বাধীনতাসহ সব মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা না থাকায় রোহিঙ্গারা ফিরতে চায়নি। (৬) প্রত্যাবর্তন চুক্তি সম্পাদনের আগে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ফর্মালি অথবা ইনফরমালি কোনো আলাপ-আলোচনা করা হয়নি বলেই রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন। (৭) সর্বোপরি, প্রত্যাবর্তন চুক্তিটির কোনো শক্তিশালী গ্যারান্টর (যেমন জাতিসংঘ) না থাকা। যদিও বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিসরে রোহিঙ্গা সংকটকে তুলে ধরেছে, কিন্তু চীন ও ভারত বাংলাদেশের প্রথম ও দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও তারা বাংলাদেশ কিংবা মানবতার পক্ষে ছিল না, এটাই হলো বাস্তবতা। মানবিকতার চেয়ে ভূকৌশলগত স্বার্থ তাদের কাছে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণিত হয়েছিল। রাখাইন অঞ্চলটি ভারত মহাসাগরে মেরিটাইম সিকিউরিটির জন্য কৌশলগত গুরুত্ব থাকার কারণেই, চীন, পশ্চিমা বিশ্বের অবরোধের মুখে মিয়ানমারকে দীর্ঘদিন সমর্থন এবং সহযোগিতা করে এসেছে।

তবে দীর্ঘদিনের সামরিক শাসন, জাতি নিধন এবং গণতন্ত্র ও বাক-স্বাধীনতার অভাবে মিয়ানমার রাষ্ট্রটি ভেঙে পড়ার উপক্রমণ হয়েছে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন করে আসছে। যেমন রাখাইনে, আরাকানিসরা স্বাধীন আরাকান সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির যুদ্ধ চলছে, বর্তমানে আরাকানের প্রায় ৯০ ভাগ এলাকা আরাকান আর্মি দখল করে নিয়েছে। উল্লেখ্য, রাখাইনের এই গৃহযুদ্ধের মধ্যেও প্রায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা, মিয়ানমার জান্তা বাহিনীর মতো আরাকান আর্মির দ্বারাও গত কয়েক বছর ধরে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। টেকনাফের একজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আরাকান আর্মি অনেক রোহিঙ্গাকে মংডু থেকে জাতি নিধনের মাধ্যমে বিতাড়িত করছে। বিশেষ করে আরাকান আর্মি নিরস্ত্র রোহিঙ্গাদেরকে ARSA (Arakan Rohingya Salvation Army)-র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগ করছে। কথিত আছে, রাখাইনের গৃহযুদ্ধে সামরিক জান্তাকে সাহায্য করছে। বার্মা এক্টের মাধ্যমে আমেরিকা মিয়ানমারে গণতন্ত্র বিকশিত করতে চায়, তাই আরাকান আর্মি মার্কিন সাহায্য পেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

তবে জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, এই গৃহযুদ্ধের কারণে রাখাইনে খাদ্য সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, এমনকি দুর্ভিক্ষও দেখা দিতে পারে। এই পরিস্থিতিতে, জাতিসংঘ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে, অর্থাৎ কক্সবাজার সীমান্ত এলাকা থেকে রাখাইনের মধ্যে একটি মানবিক করিডোর তৈরি করে রোহিঙ্গাদের মধ্যে খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ করার জন্য বাংলাদেশের সহযোগিতা চাচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কি জাতিসংঘের প্রস্তাবিত এই মানবিক করিডোর তৈরিতে অনুমতি দেবে? এই করিডোরের মেরিট এবং ডিমেরিট কী? করিডোর নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে এক ধরনের বিতর্ক দেখা দিয়েছে। বিএনপির মহাসচিব জনাব ফখরুল ইসলাম আলমগীর, এই করিডোরের কারণে বাংলাদেশ গাজায় পরিণত হবে বলে মন্তব্য করেছেন, যেটি একটি বড় ধরনের দুশ্চিন্তার বিষয়। বাংলাদেশের মানুষের জন্য ভয়ের বিষয় হলো, রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে গিয়ে বাংলাদেশ কি কোনো যুদ্ধের ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে? বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা কি হুমকির মধ্যে পড়বে? কিন্তু একই সময়ে প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কিভাবে হবে? গত ৮ বছরে যখন কোনো প্রচেষ্টাতেই একজন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো যাইনি, তখন জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা বিশ্বের সহযোগিতায় রোহিঙ্গাদেরকে এই মানবিক করিডোরের মাধ্যমে ফেরত পাঠানোর কোনো সুযোগ এবং সম্ভাবনাকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ না করেই বাতিল করে দেওয়াটা ঠিক হবে কি?

একটি বিষয় এখানে পরিষ্কার যে, রোহিঙ্গাদের রাখাইনে পাঠানোর জন্য জাতিসংঘের সহযোগিতা বাংলাদেশের লাগবে। যদিও মিয়ানমার সরকার সম্প্রতি বলেছে যে, তারা ১ লাখ ৮৫ হাজার রোহিঙ্গা ফেরত নেবে, কিন্তু চুক্তি ভঙ্গ করার অতীত রেকর্ড এবং রাখাইনের অধিকাংশ এলাকা আরাকান আর্মির দখলে চলে যাওয়ায়, মিয়ানমার সরকারের এই বক্তব্যের ওপর কতটুকু নির্ভর করা যাবে- এই প্রশ্ন থাকছে। আরাকান আর্মি স্বাধীনতার পথেই হাঁটছে, তবে বাংলাদেশ কি আরাকান আর্মিকে সহযোগিতা করা উচিত? পরিষ্কার উত্তর হচ্ছে, বাংলাদেশ অনেক সমস্যায় জর্জরিত, তাই এদেশের আপাময় জনগণ মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে জড়াতে চাইবে না। রোহিঙ্গাদেরকে আমরা মানবিক সাহায্য দিচ্ছি, কিন্তু তাদের জন্য কোনো যুদ্ধে বাংলাদেশ জড়িত হওয়ার সুযোগ নেই।

এখানে সঙ্গত কারণে প্রশ্ন আসে, রোহিঙ্গারা তাদের নিজ ভূমির জন্য যুদ্ধ করে না কেন, যেমনটা আরাকানিসরা করছে? ওরা শুধু পালিয়ে আসে কেন? তাদের কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়নি কেন? যে কোনো জাতিগোষ্ঠী তাদের স্বাধীনতা কিংবা নিপীড়ন এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব বা রাজনৈতিক নেতার আবির্ভাব অপরিহার্য। 'রোহিঙ্গা ভয়েস' শিরোনামে একটি গবেষণা করতে আমি দেখতে পেয়েছি, রোহিঙ্গাদের শক্তিশালী কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি। তাদের কোনো রাজনৈতিক প্লাটফর্ম নেই, যারা রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। এই অবস্থায়, আমি একটি ইউনাইটেড রোহিঙ্গা ভয়েসের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য বলে মনে করি। বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার সহযোগিতায় রোহিঙ্গাদের ইউনাইটেড ভয়েস প্রতিষ্ঠার জন্য যৌক্তিকভাবে কাজ করতে পারে। এই বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, রোহিঙ্গা-বিশেষজ্ঞ এবং নাগরিক সমাজকে নিয়ে কিভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য কোনোভাবেই হুমকি না হয়ে একটি 'ইউনাইটেড রোহিঙ্গা লিডারশিপ' তৈরি করা যায়, তা নিয়ে কাজ করতে পারে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের জন্যও এই লিডারশিপ ভূমিকা রাখবে। নেতৃত্বহীন একটি জাতি, কাণ্ডারি ছাড়া জাহাজের মতো, যা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না।  

প্রফেসর ইউনুস জাতিসংঘের মহাসচিব এবং এক লাখ রোহিঙ্গার উপস্থিতিতে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আশ্বাস দিয়েছেন যে, রোহিঙ্গারা আগামী বছর ঈদ তাদের নিজ মাতৃভূমিতে করতে পারবেন। আন্তর্জাতিকভাবে ড. ইউনূসের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার কারণে, বাংলাদেশের মানুষ রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে উনার এই বক্তব্যে একটা আলোর রেখা দেখতে পেয়েছে।

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে একটি মানবিক করিডোর সৃষ্টির বিষয়ে নিচের বিষয়গুলোকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, রাজনৈতিক দল এবং সব স্টেকহোল্ডারদের আমলে নেওয়া প্রয়োজন :

(১) জাতিসংঘ এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মানবিক করিডোরের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা, সম্মানজনক এবং স্থায়ী প্রত্যাবর্তন করার বিষয়ে একটি স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া উচিত। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, আপাময় জনগণ, বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত রোহিঙ্গা এবং হোস্ট কমিউনিটির মধ্যে মানবিক করিডোর নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা এবং ভয় কাজ করছে। (২) এই মানবিক করিডোর কোনোভাবেই বাংলাদেশকে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ কিংবা বে অফ বেঙ্গলে বৈশ্বিক শক্তির কোনো সংঘর্ষে জড়াবে না, সরকারকে তা পরিষ্কার করা। (৩) জাতিসংঘের ম্যান্ডেট নিয়ে, মানবিক করিডোরের নিরাপত্তায় যদি বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, শান্তিরক্ষী বাহিনীর অথবা টেকনিক্যাল কোনো দায়িত্বে থাকে, সেক্ষেত্রে এই মানবিক করিডোরের নিরাপত্তার জন্য জাতিসংঘের R2P(Responsibility to Protect) সনদ অনুযায়ী, সেফজোন সৃষ্টি করা, যাতে এই সেফজোনে মিয়ানমার বাহিনী এবং আরাকান আর্মি কোনো রকম সংঘাতে লিপ্ত হতে না পারে, যাতে মানবিক করিডোরের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদেরকে সেফজোনে নিরাপদে পাঠানো যায়। (৪) পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোঃ তৌহিদ হোসেন সম্প্রতি একটি সেমিনারে বলেছেন, যেকোনো টেকসই প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টায় সব অংশীদারদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, বিশেষ করে আরাকান সেনাবাহিনী, যারা এখন রাখাইন রাজ্যের বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। পাশাপাশি, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান ভিন্ন এক জায়গায় বলেছেন রাখাইনে, আরাকান আর্মির দ্বারা রোহিঙ্গাদের জাতি নিধন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং আরাকান প্রশাসনের সর্বস্তরে রোহিঙ্গাদের অবস্থান থাকতে হবে। এটি বাস্তবায়িত হলে প্রশংসার দাবিদার। প্রশ্ন হলো, আরাকান আর্মি কি রোহিঙ্গাদের সব ন্যায্য দাবি মেনে নেবে, তাদের সব নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেবে? এই বিষয়ে জাতিসংঘ এবং আমেরিকা কি কোনো গ্যারান্টি দেবে? আরাকান আর্মি যদি ভারত দ্বারা প্রভাবিত হয় তাহলে, বাংলাদেশ কিভাবে তা কাউন্টার দেবে? (৫) চীন বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্টনার এবং প্রতিবেশী। বিশাল ভারত বনাম পাকিস্তানের যুদ্ধের আপাতত যে পরিণতি, তাতে অনুধাবণ করা যায় চীনের প্রভাব এবং প্রতিপত্তিকে অবজ্ঞা করার সুযোগ বাংলাদেশের নেই। তাই চীন এই করিডোর নিয়ে কি ভাবছে তা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা, ভূকৌশল, অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং বে অফ বেঙ্গলে, আমেরিকার মেরিটাইম সিকিউরিটির পরিকল্পনা চীন কিভাবে রিঅ্যাক্ট করবে। (৬) করিডোর হোক বা না হোক, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। তিন বাহিনী এবং বিজিবিকে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত করতে হবে, যে কোনো পরিস্থিতিতে যেন মিয়ানমার কিংবা আরাকান বাহিনী, অথবা ভারত বাংলাদেশকে দুর্বল বা অসহায় না ভাবে। বাংলাদেশের ১ কোটি তরুণকে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

 বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা রোহিঙ্গাদেরকে দ্রুত প্রত্যাবর্তন। জাতিসংঘ, আমেরিকা এবং চীনের সহযোগিতায় রোহিঙ্গা সংকটের দ্রুত সমাধান দরকার। তা না হলে, এই সংকট আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটা বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। জাতিসংঘ যদি সিকিউরিটি কাউন্সিলের ম্যান্ডেট নিয়ে রাখাইন একটি সেফজোন করতে পারে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে তার নৈতিক দায়িত্ব পালন করবে। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় নিরাপাত্তা এবং মানবিক চ্যানেল বা করিডোর নিয়ে দ্রুত সংলাপের আয়োজন করতে পারেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছাত্রজনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়েই দেশ পরিচালনার লেজিটিমেসি পেয়েছে। তবে যুদ্ধ, মানবিক করিডোরের মতো স্পর্শকাতর বিষয় সরকার অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলো এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। যদি মানবিক করিডোরের মেরিট থাকে, তা বাংলাদেশের মানুষ গ্রহণ করবে, মেরিট না থাকলে প্রত্যাখ্যান করবে। বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ এবং নিরাপত্তা কোন রাষ্টের সঙ্গে কিভাবে সমঝোতা করলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সামরিক এবং কৌশলগতভাবে লাভবান হবে, তা জাতীয় নেতৃত্ব এবং দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্বকে তীক্ষ্ণভাবে বিশ্লেষণ করে অনুধাবন করতে হবে, এটাই জাতির প্রত্যাশা।

লেখক : ডিপার্টমেন্ট অফ পলিটিক্যাল সাইন্স এন্ড সোসিওলজি

পরিচালক, সেন্টার ফর পিস স্ট্যাডিজ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি