ভালো ফলনেও সুফল নেই

রেজাউল রেজা
১৭ মে ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ভালো ফলনেও সুফল নেই


লম্বা সময় ধরে চালের পেছনে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে ভোক্তাদের। এর মধ্যে সরু চালের দাম ভুগিয়েছে বেশি। ভোক্তারা আশায় ছিলেন, বোরো মৌসুমে চালের দাম কমে সহনীয় পর্যায়ে আসবে। কিন্তু নতুন চাল বাজারে ওঠার পর সরু চালের দাম কিছুটা কমলেও এখনও প্রতি কেজি কিনতে হচ্ছে ৭৫ থেকে ৭৬ টাকা দরে। এ দামও বেশির ভাগ ক্রেতার নাগালের বাইরে রয়েছে। এদিকে বিকল্প মাঝারি চালের দামও আগের মতো চড়া রয়েছে। অন্যদিকে মোটা চালও মোটা দামে কিনে খেতে হচ্ছে দরিদ্রদের।

জানা গেছে, ধানের সর্বাধিক উৎপাদনশীল মৌসুম হচ্ছে বোরো। কেননা দেশের মোট উৎপাদনের বড় একটি অংশ আসে এ মৌসুম থেকে। এবার আবহাওয়া ও সার্বিক পরিস্থিতি অনুকূলে থাকায় বোরোর ফলন সন্তোষজনক। নির্বিঘেœ কৃষকের ঘরে উঠছে বোরো ধান। ইতোমধ্যে ৭২ শতাংশ আবাদি জমির ধান কাটা হয়ে গেছে। ফলন বিবেচনায় চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার অধিক উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বোরো মৌসুমের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, এবার সারাদেশে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে ৫০ লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। আর চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ কোটি ২৬ লাখ টন। সেখানে ইতোমধ্যে ৭২ দশমিক ২ শতাংশ ধান কাটা হয়ে গেছে। এরই মধ্যে বোরো মৌসুমের চাল উৎপাদন দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ কোটি ৬২ লাখ টন। এবার ফলন দাঁড়িয়েছে হেক্টরপ্রতি

৪ দশমিক ৪৪ টন।

কথা হলে অধিদপ্তরের সরেজমিন শাখার অতিরিক্ত পরিচালক (সম্প্রসারণ ও কো-অর্ডিনেশন) ড. মো. আব্দুল আজিজ বলেন, এবার আবহাওয়াসহ সবকিছু অনুকূলে রয়েছে। ভালো ফলন হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সামান্য যে বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে তেমন প্রভাব ফেলবে না। ইতোমধ্যে ৭২ শতাংশ ধান কাটা শেষ। এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে বলে আশা করা যায়, অধিকও হতে পারে।

এদিকে বাজারে নতুন চাল উঠেছে বলে জানিয়েছেন চাল ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, এতে দাম কমতে শুরু করেছে। খুচরায় সরু চালের মধ্যে মিনিকেট হিসেবে পরিচিত চালের দাম কেজিতে ১০ থেকে ১৩ টাকা পর্যন্ত কমেছে। আগে যে মিনিকেট ৮৮ টাকা বিক্রি হতো, এখন তা ৭৬ টাকা বিক্রি হচ্ছে। তবে পুরনো চালের কেজি ৮০ টাকা থেকে বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে। আর মাঝারি চাল ৬২ থেকে ৬৪ এবং মোটা চাল ৫৪ থেকে ৫৬ টাকা বিক্রি হচ্ছে।

কথা হলে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির নেতারা জানান, মূল্যস্ফীতির কারণে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ধানের দাম বাড়তি। এতে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। তবে নতুন চাল বাজারে ওঠায় আগের চেয়ে দাম কমেছে।

বাজারে আসা ক্রেতারা বলছেন, সরু চালের দাম কমার পরও অনেক বেশি রয়েছে। ৭৬ টাকা কেজি দরে চাল কেনা অনেকের পক্ষেই কষ্টকর। অন্যদিকে মাঝারি চালের দামও চড়া।

মালিবাগ বাজারে গতকাল চাল কিনতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী মো. এনামুল হক বলছিলেন, এটাকে ‘কমা’ বলে না। এক সময় ৬৪-৬৬ টাকা বিক্রি হওয়া চালের দাম ধাপে ধাপে বেড়ে ৮৮ টাকা কেজি হয়েছে। সেখান থেকে কমে এখন ৭৫-৭৬ টাকা হয়েছে। এ দামেও তো কেনা কঠিন। বিকল্প হিসেবে যে মাঝারি চাল খাব, সেটার কেজিও ৬৪ টাকা।

বাজার সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বোরো মৌসুমে যে ফলন হয়, তাতে চালের দাম কমে। এ সময় নতুন চাল উঠলে বাজারে অনেকটা স্বস্তি মেলে। কিন্তু এবার ভরা মৌসুমেও সরু চালের দাম চড়া। কমেনি অন্যান্য চালের দামও। গত বছরের তুলনায় দাম অনেকটা চড়া রয়েছে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদন বলছে, গত বছর এমন সময়ের তুলনায় বর্তমানে সরু চালের দাম ১৪ শতাংশ বেশি রয়েছে। আর মাঝারি চাল ১২ শতাংশ ও মোটা চাল ৩ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

কারওয়ান বাজারের মোশাররফ হোসেন, মো. জনিসহ কয়েকজন পাইকারি বিক্রেতা জানান, বোরো মৌসুমে ফলন ভালো হলে চালের বাজারে স্বস্তি থাকে। যদিও বাজারে দাম কমা কিংবা বৃদ্ধি পাওয়া ফলনের ওপর যতটা নির্ভর করে তার চেয়ে বেশি নির্ভর করে মিলগুলোর ওপর। তারা যে দামে ছাড়ে সে দামেই কিনতে এবং বিক্রি করতে হয়।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, সরু চালে অত্যাধিক দাম বাড়ার পর যেটুকু কমেছে সেটাও অনেক বাড়তি। বাজার ব্যবস্থাপনা ও নজরদারির ঘাটতির সুযোগ নিয়ে বড় ব্যবসায়ীরা এখনও বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে যৌক্তিক দামে চাল কিনে খেতে পারছে না ভোক্তারা।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, দাম কমার পর সরু চাল যে দামে বিক্রি হচ্ছে সেটাকে সহনীয় বলা যায় না। সরু চালের দাম ৬২ থেকে ৬৪ টাকার বেশি হওয়ার কথা না। মাঝারি ও মোটা চালের দামও অনেক চড়া। ৫৫-৫৬ টাকা দিয়ে মোটা চাল কিনে খেতে নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট হচ্ছে। এমনিতেই মূল্যস্ফীতির তুলনায় মানুষের আয় সেভাবে বাড়েনি। ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। তাই বাজারে চালের মতো অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যাতে অযৌক্তিকভাবে না বাড়ে, সেদিকে নজর রাখা জরুরি। অন্যান্য পণ্যের বাজারের তুলনায় ধান-চালের বাজারে নজরদারির ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, চালের বাজার এখনও বড় খেলোয়াড়দের কবজায় রয়ে গেছে। বড় মিল ও করপোরেটদের আধিপত্য কমেনি। আমরা দেখতে পাই, চালের ভালো ফলন, এমনকি বিদেশ থেকে আমদানির পরও দাম এখনও অনেক চড়া। ভোক্তারা যৌক্তিক দামে কিনে খেতে পারছেন না।

ক্যাব সহসভাপতি বলেন, ধানের দাম বেশি পেলে কৃষকরা লাভবান হন ঠিক আছে। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, বাজারে চালের দাম অত্যাধিক বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে প্রসাশনের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে অসাধুরা। মিলগুলোতে নজরদারি থাকতে হবে। কোথায় কত মজুদ হচ্ছে, কত দামে কেনা আর কত দামে বাজারে ছাড়া হচ্ছে- এগুলো খতিয়ে দেখতে হবে। তাহলে অসাধুরা দাম অতিরিক্ত বাড়িয়ে অল্প সময়ে অতিরিক্ত মুনাফা লুটে নিতে পারবে না।