পাসপোর্ট ব্লক করার তালিকা বড় হচ্ছে
মধ্যরাতে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিদেশ গমনের পর পতিত শেখ হাসিনা সরকারের আমলের সুবিধাভোগী, দুর্নীতিবাজ এবং গুম-খুন ও জুলাই হত্যাকা-ে সংশ্লিষ্টদের দেশত্যাগ রোধে নড়েচড়ে বসেছে ইমিগ্রেশন পুলিশ। দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার তালিকার শীর্ষে রয়েছে শেখ হাসিনা পরিবার ও তাদের ঘনিষ্ঠরা। এরই অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থর স্ত্রী ও সাবেক এমপি শেখ হেলালের মেয়ে শেখ শাইরা শারমিনকে বিদেশযাত্রায় বাধা দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ। আর গতকাল বৃহস্পতিবার বিএনপির এক বহিষ্কৃত নেতার বিদেশযাত্রা আটকে দেওয়া হয়।
ইমিগ্রেশন পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, যেসব ব্যক্তির বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারির সিদ্ধান্ত রয়েছে, তাদের
ব্যক্তিগত পাসপোর্ট ইমিগ্রেশন পুলিশের ফরট্র্যাক সফটওয়্যারে ব্লকড করে রাখা হয়। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আর বিদেশ গমন করতে পারেন না। প্রতিদিনই বড় হচ্ছে এ সফটওয়্যারে ব্লকড পাসপোর্টধারীর তালিকা। দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা প্রায় প্রতিদিনই হালনাগাদ করছে ইমিগ্রেশন পুলিশ। আদালত ছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যেসব ব্যক্তির তালিকা ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে পাঠানো হয়, সেটি হালনাগাদ করার পাশাপাশি ফরট্র্যাক সফটওয়্যারে ইনপুট দিচ্ছেন ইমিগ্রেশন পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও।
পুলিশের বিশেষ শাখা সূত্রে জানা গেছে, গত ৭ মে গভীর রাতে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ থাইল্যান্ডের উদ্দেশে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। তার বিদেশযাত্রায় অনুমতি দেওয়ায় প্রচ- সমালোচনার মুখে পড়ে ইমিগ্রেশন পুলিশ। পরবর্তীকালে এ কা-ে দায়িত্বপালনে অবহেলার অভিযোগে ইমিগ্রেশন পুলিশের একজন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার এবং আরেকজন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ছাড়া ঘটনাটি তদন্তে পুলিশ সদর দপ্তর একটি কমিটি গঠন করে। পরবর্তীকালে তিন উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে সরকার। ইতোমধ্যে দুই কমিটিই বেশ গুরুত্বের সঙ্গে তাদের তদন্তকাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ইমিগ্রেশন পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের সময়’কে বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ঘটনার পর স্পেশাল ব্রাঞ্চ প্রধানের পক্ষ থেকে কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়েছে দেশের সব ইমিগ্রেশন পুলিশের চেক পয়েন্টে। তালিকাভুক্ত ও সন্দেহভাজন কেউ যাতে দেশত্যাগ করতে না পারেন, সে জন্য সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়াও সব স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশন চেক পয়েন্টে সর্বোচ্চ সতর্কতায় দায়িত্ব পালন করছেন ইমিগ্রেশন পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যরা।
জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরই ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে ৬ শতাধিক ব্যক্তির তালিকা আসে তাদের দেশত্যাগ রোধে। তালিকায় সাবেক মন্ত্রী-এমপি ছাড়াও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা রয়েছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী ও দুর্নীতিগ্রস্ত দুই শতাধিক মেয়র, কাউন্সিলর ও ব্যবসায়ীর নামও রয়েছে ওই তালিকায়।
পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলি চালানোর মদদদাতা, হুমুকদাতা ও মাঠে দায়িত্ব পালন করা সাবেক দুই আইজিপিসহ অর্ধশতাধিক আমলা-পুলিশ কর্মকর্তার পাসপোর্টও ইমিগ্রেশন পুলিশের ফরট্র্যাক সফটওয়্যারে ব্লকড করা হয়। এমনকি বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় নায়ক-নায়িকাসহ কয়েকজন সেলিব্রেটি অভিনেতা-অভিনেত্রীর নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরেল জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, গুলিবর্ষণ ও হত্যাকা-ের ঘটনায় একের পর এক সারাদেশে মামলা করা হয়। এসব মামলার আসামিদেরও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে ইমিগ্রেশন পুলিশ।
এদিকে গুম কমিশন থেকে অর্ধশতাধিক সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তার নাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের কাছে পাঠানো হয়। সুরক্ষা সেবা বিভাগ তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চের অতিরিক্ত আইজিপির কাছে চিঠি পাঠায়। তাদের পাসপোর্টও ব্লক করা হয়েছে ইমিগ্রেশন পুলিশের ফরট্র্যাক সফটওয়্যারে। এ তালিকায় সাবেক আইজিপি, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি, সাবেক ৭ জন মেজর জেনারেল, সাবেক দুজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ছাড়াও বিভিন্ন পদবির পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তার নাম রয়েছে। কমিশনের তদন্তে তাদের বিরুদ্ধে গুমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই আন্দোলনের সময় সাড়ে তিন শতাধিক এমপি-মন্ত্রীর মধ্যে সরকারের পতন আঁচ করতে পেরে ৪৬ জন আগেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। অন্যদের পলায়ন রোধে পাসপোর্ট ব্লক করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ ছাড়া তারা যেন সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে দেশ ছাড়তে না পারেন, সে জন্য সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিকে সব সীমান্তে সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিমানবন্দর ও সীমান্তের চেকপোস্ট দিয়ে কোনো কোনো মন্ত্রী-এমপি দেশছাড়ার চেষ্টা করেন। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে সরকার পতনের পরপরই ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ৬ ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন