বাতাসে আগুনের হল্কা

আসাদুর রহমান, ঢাকা
১১ মে ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বাতাসে আগুনের হল্কা

চৈত্রের শেষ আর বৈশাখের শুরুতে সাধারণত গরমের তীব্রতায় হাঁসফাঁস করতে হয়। তবে এবার তীব্র গরম দেখা যাচ্ছে বৈশাখের শেষ দিকে এসে। সূর্যের প্রখরতায় হাঁসফাঁস হয়ে উঠেছে জনজীবন। তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। সারাদেশের হিসেবে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়। আর ঢাকায় বিরাজ করছে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। গতকাল শনিবার আবহাওয়া অধিদপ্তর এসব তথ্য জানিয়েছে।

আবহাওয়াবিদ শাহানাজ সুলতানা বলেন, গতকাল শনিবার ঢাকায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। আর সারাদেশের মধ্যে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তিনি জানান, দেশের অনেক অঞ্চলের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির ওপরে। এটি অব্যাহত থাকতে পারে। তবে কিছু এলাকায় বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। এর মধ্যে রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৯ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় দেশের ইতিহাসে চতুর্থ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০২৩ সালের ১৭ এপ্রিল পাবনার ঈশ্বরদীতে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল। তার আগে ১৯৯৫ ও ২০০২ সালেও একই তাপমাত্রা রেকর্ড হয়, যা দেশের ইতিহাসে চতুর্থ সর্বোচ্চ। আর ২০১৪ সালের ২১ মে চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ওঠে ৪৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ। ১৯৮৯ সালের ২১ এপ্রিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়েছিল বগুড়ায়। আর স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ মে ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল রাজশাহীতে, যা বাংলাদেশের নথিভুক্ত ইতিহাসের সর্বোচ্চ।

আর গত বছরের ২০ এপ্রিল ঢাকায় ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছিল তাপমাত্রা। আর ২০২৩ সালের ১৬ এপ্রিল ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি। তার আগে ১৯৬৫ সালে এপ্রিল মাসে ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আর ১৯৬০ সালে ঢাকায় পারদ উঠেছিল রেকর্ড ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি। এবার দেশের সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছানোর বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রার পারদ চড়তে থাকে, গতকাল বিকাল ৩টায় যা ৪২ ডিগ্রিতে গিয়ে ঠেকে।

গত এপ্রিল মাসে দেশে তাপপ্রবাহ অপেক্ষাকৃত কম ছিল। মে মাসের শুরু থেকে তাপমাত্রা মোটামুটি স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু গত বুধবার থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বিরাজ করছে। গত শুক্রবার দেশের ৪৫টি জেলায় তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা ও রাজশাহী জেলায় তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। ঢাকা ও চুয়াডাঙ্গা ছাড়াও দেশে বেশকিছু জেলার তাপমাত্রা আজ ৪০ ডিগ্রিতে উঠেছে। এর মধ্যে যশোরে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ দশমিক ২, রাজশাহীতে ৪০ দশমিক ৭, মানিকগঞ্জের আরিচায় ৪০, ফরিদপুরে ৪০ এবং টাঙ্গাইলে ৪০ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শনিবার (গতকাল) রাতে দেশের তিন অঞ্চলে ঝড় হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এসব অঞ্চলের নদীবন্দরগুলোকে সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ ওয়েদার অবজারভেশন টিম (বিডব্লিউওটি) জানিয়েছে, আগামী ১৬ থেকে ১৮ মে’র মধ্যে বঙ্গোপসাগরে একটি ঘূর্ণয়ন সৃষ্টি হতে পারে। এটিই পর্যায়ক্রমে ঘনীভূত হয়ে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে।

বিডব্লিউওটি জানায়, দেশের ওপর দিয়ে শক্তিশালী তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে খুলনা, রাজশাহী, ঢাকা ও বরিশাল বিভাগে তাপপ্রবাহের তীব্রতা বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ১৩ মে থেকে তাপপ্রবাহর শক্তি কমতে শুরু করবে ও ১৫ মে চলামান তাপপ্রবাহ পুরোপুরি শক্তি হারাবে। তবে খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল ও রংপুর বিভাগে ও ঢাকা বিভাগের কিছু এলাকায় তাপপ্রবাহ ১৫ মে পর্যন্ত সক্রিয় থাকতে পারে, যা আগামী ১৩ মে পর্যন্ত তীব্র থাকতে পারে। চলমান তাপপ্রবাহের ফলে ১২ মে পর্যন্ত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হতে পারে।

সংস্থাটি জানায়, চলমান এই তাপপ্রবাহের পরপরই দেশের দিকে একটি ক্রান্তীয় আংশিক বৃষ্টিবলয় আসবে, যা আগামী ১৩ মে থেকে দেশের ওপর সক্রিয় হতে পারে এবং আগামী ১৫ মে থেকে দেশের অনেক এলাকায় অধিক সক্রিয় হতে পারে। এই বৃষ্টি বলয়ের জন্য তাপপ্রবাহ কমে যাবে। এটি একটি শক্তিশালী ও তীব্র বজ্রপাতযুক্ত বৃষ্টিবলয়, যা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকতে পারে সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগে। সক্রিয় থাকতে পারে ১৩-২০ মে পর্যন্ত। বেশি সক্রিয় থাকতে পারে ১৫-১৯ মে পর্যন্ত। এরপর তীব্র তাপপ্রবাহ আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

আমাদের সময়ের জীবননগর (চুয়াডাঙ্গা) প্রতিনিধি আকিমুল ইসলাম জানান, চুয়াডাঙ্গায় দাবদাহে জনজীবন কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। রোদের তীব্রতায় সড়কের পিচ গলে যাচ্ছে। গরমে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন খেটে খাওয়া নিম্নআয়ের মানুষ। শুধু শ্রমজীবী নয়, শিশু, বৃদ্ধ এবং অসুস্থরাও চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। জেলা সদর হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হিটস্ট্রোক, পানিশূন্যতা ও ঘামজনিত সমস্যার রোগী বাড়ছে।

গতকাল বিকাল ৩টায় চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ০ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। এ সময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ১৬ শতাংশ। এর আগে দুপুর ১২টায় চুয়াডাঙ্গার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ দশমিক ০ ডিগ্রি। বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ২৯ শতাংশ। শুক্রবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি। চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের জেষ্ঠ কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

বগুড়া প্রতিনিধি এমএ মজিদ জানান, বগুড়ায় গতকাল এই মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙেছে। বিকাল ৩টায় জেলায় ৩৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি তাপমাত্রার রেকর্ড করা হয়, যা এই মৌসুমের এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। আগের দিন ৩৯ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়। এসব তথ্য জানিয়েছেন বগুড়া আবহাওয়া অফিসের উচ্চ পর্যবেক্ষক শাহ আলম।

ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধি ওয়াহিদুল ইসলাম ডিফেন্স জানান, প্রচণ্ড তাবদাহে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বেড়েছে রোগীর সংখ্যা। অনেকে জ্বর, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। গতকাল দুপুর ৩টায় জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৮ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, শনিবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত আন্তঃবিভাগে ১৫ জন ডায়রিয়ার রোগী ভর্তি হয়েছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) ডা. নূর-ই-আলম জানান, তাপদাহে ডায়রিয়া, ঠাণ্ডা-জ্বর ও সর্দি-কাশির প্রকোপ বেড়েছে।

দিনাজপুর আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন জানান, শনিবার দুপুর ৩টায় জেলায় ৩৮.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এই অবস্থা আরও দুয়েক দিন বাজায় থাকবে। তারপর কিছু এলাকায় বৃষ্টি হতে পারে, যা তাপমাত্রা কিছুটা কমাতে সহায়ক হবে।