নাটকীয়তা শেষে গ্রেপ্তার আইভী কারাগারে

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি ও গাজীপুর প্রতিনিধি
১০ মে ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
নাটকীয়তা শেষে গ্রেপ্তার আইভী কারাগারে

রাতভর নাটকীয়তা শেষে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হত্যা ও হামলার অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় গতকাল শুক্রবার সকাল পৌনে ৬টার দিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে সকাল ১০টার দিকে আদালতে হাজির করলে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এর পর আইভীকে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে নেওয়া হয়। সেখান থেকে দুপুরে স্থানান্তর করা হয় গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ২০২২ সালে টানা তৃতীয়বারের মতো নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) মেয়র হন সেলিনা হায়াৎ আইভী। জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আগস্টেই আইভীসহ দেশের ১২টি সিটি মেয়রকে অপসারণ করা হয়।

এদিকে, নাসিকের সাবেক এই মেয়র ও নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি সেলিনা হায়াৎ আইভীকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এসেছে। গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালা বদলের পর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, এমপি, মেয়রসহ নারায়ণগঞ্জের অধিকাংশ নেতাকর্মী পালিয়ে গেলেও আইভী রহমান এতদিন নিজের দেওভোগের বাসাতেই ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে সাবেক এই মেয়রের দেওভোগের ‘চুনকা কুটির’ বাড়িতে প্রবেশ করে পুলিশ। এ সময় খবর পেয়ে কয়েক হাজার নেতাকর্মী, সমর্থক ও এলাকাবাসী আইভীর বাড়ির সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। পরে তারা সড়ক অবরোধ এবং বাড়ির চারপাশ ঘিরে রাখেন। এ সময় তারা ‘রাতের আঁধারে’ আইভীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে দেবেন না বলে স্লোগান দিতে থাকেন। পরে অতিরিক্ত পুলিশ পাঠানো হলেও এলাকাবাসীর বাধার মুখে তারা পিছু হটেন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাড়ির ভেতরে গিয়ে আইভীর সঙ্গে কথাও বলেন। তবে তিনি ‘রাতে কোথাও যাবেন না’ বলে জানান। রাতভর অপেক্ষার পর গতকাল শুক্রবার সকাল পৌনে ৬টার দিকে শহরের দেওভোগের বাসা থেকে বেরিয়ে স্বেচ্ছায় পুলিশের গাড়িতে ওঠেন। এ সময় হাজারো নারী-পুরুষ আইভীর পক্ষে স্লোগান দিতে থাকেন। 

গ্রেপ্তারের সময় সেলিনা হায়াৎ আইভী সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা না দেখিয়ে আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলা যদি অপরাধ হয়ে থাকে, তা হলে আমি অপরাধী। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে ২১ বছরের সেবায় কোনো দল কিংবা ব্যক্তিকে আঘাত করার মতো কিছু কখনও করিনি। যখনই নারায়ণগঞ্জে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তখনই প্রতিবাদ করেছি। কোনো অপরাধ না করে অপরাধী হিসেবে গ্রেপ্তার করা বৈষম্য। 

এ সময় পুলিশের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে আইভী বলেন, আমি প্রশাসনের কাছে জানতে চাই। বর্তমান যারা সরকারে আছেন, তারা সাম্যের কথা বলেছেন; বৈষম্যের বিরুদ্ধে আপনারা আন্দোলন করেছেন, সরকারকে হটিয়ে নতুন সরকারে এসেছেন- তা হলে কী এই বৈষম্য? তা হলে সৎ রাজনীতি, সততার কী মূল্যায়ন? আমি তো বাড়িতেই ছিলাম, পালাইনি। তা হলে এভাবে আমাকে গ্রেপ্তার করতে হলো কেন? সেই জবাব জনগণের কাছে চাই, জনগণই দেবে। ইনশা আল্লাহ। শেষে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে বিগত সময়ের মতো নারায়ণগঞ্জবাসীকে পাশে থাকার আহ্বান জানান তিনি। 

অন্যদিকে, আইভীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার সময় শহরের বিবি রোডের কালীর বাজার এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ ও পুলিশের গাড়িবহরের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। পরে শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় সিদ্ধিরগঞ্জের মিনারুল হত্যা মামলায় সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্র্রেট-১-এর বিচারক মো. মাঈনউদ্দিন কাদিরের আদালতে আইভীকে হাজির করা হয়। শুনানি শেষে আদালত তাকে কারাগারে প্রেরণের আদেশ প্রদান করেন। পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয় আগামী ২৬ মে। 

নারায়ণগঞ্জ আদালতের পুলিশ পরিদর্শক আ. কাইউম খান জানান, সাবেক মেয়র আইভীকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সিদ্ধিরগঞ্জে মিনারুল হত্যা মামলায় কারাগারে প্রেরণের আদেশ দিয়েছেন আদালত। তার বিরুদ্ধে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মোট ৫টি মামলা রয়েছে। 

এদিকে, সেলিনা হায়াৎ আইভীকে গতকাল দুপুর ২টার দিকে নারায়ণগঞ্জ থেকে গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মোছা. কাওয়ালিন নাহার বলেন, শুক্রবার দুপুর ২টার দিকে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়েছে। এর বাইরে আপাতত বিস্তারিত কিছু বলতে পারছি না। 

অন্যদিকে, আইভীকে গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বী। গতকাল সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে শেয়ার করা এক স্ট্যাটাসে তিনি এই নিন্দা জানান। স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে আজ সকালে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। আমরা এই গ্রেপ্তারের নিন্দা জানাই। নারায়ণগঞ্জকে নরক বানিয়ে রাখা শামীম ওসমানকে সরকারের বাহিনী সসম্মানে দেশ থেকে পালাতে সহায়তা করল, তার পরিবারকে পালাতে সহায়তা করল; আর আইভীকে করা হলো গ্রেপ্তার।

মামলা প্রসঙ্গে রফিউর রাব্বী বলেন, আইভীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়েছে। তিনি শামীম ওসমানকে সঙ্গে নিয়ে হত্যা করেছেন। যে শামীম ওসমানের সঙ্গে তার সাপ-নেউলের সম্পর্ক, তাকে সঙ্গে নিয়ে আইভী হত্যা করেছেন? একদিকে সরকার বলছে, মামলা হলেই কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। তদন্ত করে প্রমাণ পেলে গ্রেপ্তার। আবার এমন রাতভর বাড়ি ?ঘিরে রেখে সকালে গ্রেপ্তার। ৫ আগস্টের পরে আইভী তো কোথাও পালিয়ে যাননি। নিজ বাড়িতেই ছিলেন, তা হলে রাতভর এসবের কী প্রয়োজন ছিল?