সীমান্তের ওপারে সহিংসতা, বাড়ছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ
বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে যুদ্ধ, সংঘর্ষ আর আতঙ্ক। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) মধ্যে সংঘর্ষে মানুষের জীবন বিপন্ন। খাদ্য ও ওষুধ সংকট বাড়ছে। জীবন বাঁচাতে উখিয়া-টেকনাফ ও বান্দরবানের সীমান্তবর্তী অন্তত ২৫টি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিনই রোহিঙ্গারা প্রবেশ করছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে ১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ ক্যাম্পে প্রবেশ করলেও অধিকাংশই চলে যাচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে। এতে করে নতুন করে নানা সংকট তৈরি হচ্ছে।
নতুন অনুপ্রবেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়েছে, শ্রমবাজারে রোহিঙ্গাদের দখল তৈরি হয়েছেÑ ভোগান্তিতে পড়েছেন স্থানীয়রা। বসতি গড়তে গিয়ে পাহাড় কেটে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা হচ্ছে। তবে রোহিঙ্গাদের দখল থেকে ৪ হাজার একর বনভূমি উদ্ধার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আরাকানে খাদ্য ও চিকিৎসা সংকটের পাশাপাশি আরাকান আর্মির নির্যাতনই অনুপ্রবেশের মূল কারণ।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, আমরা চাচ্ছি, আর কেউ যেন বাংলাদেশে না আসে। জাতিসংঘের মাধ্যমে আরাকান আর্মিকে আমরা জানিয়েছিÑ আরাকানের নতুন প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, যারা আগে এসেছেন, তারা বন কেটে পরিবেশে বিপর্যয় এনেছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত ২৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ, যার মধ্যে পাহাড় ও নদী রয়েছে। এই সীমান্তের ২৫টি পয়েন্ট দিয়ে নিয়মিত রোহিঙ্গারা বিজিবির নজর এড়িয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রবেশ হচ্ছে। এর মধ্যে টেকনাফের নীলা, জাদি মোরা, শাহপরীর দ্বীপ, হোয়াইক্যাং, জালিয়াপাড়া, মৌলভীপাড়া, কাঞ্জরপাড়া অন্যতম অনুপ্রবেশ পয়েন্ট।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম জাতীয় কমিটির মহাসচিব এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, প্রতিদিন রাত-দিন রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করছে। ধনী রোহিঙ্গারা রাজধানীসহ বড় শহরে চলে যাচ্ছে, আর গরিবরা আত্মীয়দের ক্যাম্পে বা স্থানীয়ভাবে ভাড়া বাসায় থাকছে। তিনি বলেন, ২০১৭ সালে মানবিক কারণে আশ্রয় দিলেও এখন রোহিঙ্গারা প্রধান সংকটে পরিণত হয়েছে। শ্রমবাজার দখল, আইনশৃঙ্খলা অবনতি, মুক্তিপণ আদায়, ইয়াবা পাচারসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও স্থানীয়দের দুর্ভোগ বাড়ছে। দ্রুত প্রত্যাবাসনের ওপর জোর দেন তিনি।
উখিয়ার পালংখালী সীমান্তের বাসিন্দা আব্দুল জব্বার বলেন, ভোরবেলায় নামাজে যাওয়ার সময় দেখেন কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবার অনুপ্রবেশ করছে। প্রথমে বাধা দিলেও তাদের চোখে ভয় আর নির্যাতনের কথা শুনে আটকাতে পারেননি।
আরাকানের বলিবাজার থেকে পালিয়ে আসা মোহাম্মদ নুরুল হক জানান, আরাকান আর্মির নতুন করে নির্যাতন শুরু হওয়ায় তিনি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে এসেছেন। মংডু থেকে আসা আব্দুর রহমান বলেন, পরিবারের সাত সদস্য নিয়ে ক্যাম্পে আত্মীয়ের বাড়িতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আরাকান আর্মি পুরো গ্রাম ঘেরাও করে নির্যাতন চালিয়েছে। খাদ্য, ওষুধ কিছুই নেই; গ্রাম ছাড়াও যাচ্ছে না।
কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ.না.ম. হেলাল উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে উখিয়া-টেকনাফে বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। পাহাড় কেটে করা হয়েছে ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প, যার ফলে হাতির চলাচলের ৭টি পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে মানুষ-হাতি সংঘর্ষ বাড়ছে এবং এলাকায় তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির সভাপতি মাস্টার জুবায়ের জানান, পুরো আরাকান প্রদেশজুড়ে নতুন করে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন শুরু করেছে আরাকান আর্মি। খাদ্য ও চিকিৎসা সংকট তৈরি করে রোহিঙ্গাদের তাড়ানোর জন্য গত এক সপ্তাহে ২০টি গ্রামে হামলা চালানো হয়েছে।
উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প এলাকার ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, প্রতিনিয়ত নতুন রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে প্রবেশ করছে, ফলে বাড়ছে নানা সমস্যা। কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, আমরা আর কোনো রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে চাই না। কিন্তু তারা কীভাবে ঢুকছে, সেটাও ভাবার বিষয়। দায়িত্বপ্রাপ্তদের আরও সচেতন ও দেশপ্রেমিক হতে হবে। কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের কোনো পিছুটান না থাকায় তারা ভয়াবহ অপরাধ করতেও দ্বিধা করছে না।
দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জন্য দখল হওয়া ১২ হাজার ১৬৪ একর বনভূমির মধ্যে গত দুই বছরে ৪ হাজার একর উদ্ধার করে বনায়ন করা হয়েছে। বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বন বিভাগের জমি রয়েছে ৮ হাজার ৩ একর।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, ২০২৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে ক্যাম্পে নিবন্ধিত হয়েছে। আরাকানে আরকান আর্মির দমন-পীড়ন, খাদ্য ও ওষুধ সংকট রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশমুখী করছে। তিনি জানান, নতুন রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের বিষয়ে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) বাংলাদেশকে চিঠি দিলেও এখনও জবাব দেওয়া হয়নি।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
এদিকে বিজিবির কক্সবাজার রিজওয়ান কমান্ডার এসএম ইমরুল হাসান জানান, সীমান্তে কঠোর নজরদারি চলছে, অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আধুনিক প্রযুক্তিও ব্যবহার হচ্ছে।
এ ছাড়া খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা ও পানছড়ি সীমান্ত দিয়ে ৬৬ ভারতীয় নাগরিক অনুপ্রবেশের সময় আটক হয়েছে। তারা গুজরাটের বাসিন্দা ও বাংলা ভাষাভাষী বলে দাবি করছে। বিজিবির অভিযোগ, বিএসএফ তাদের সীমান্ত দিয়ে পুশইন করেছে এবং তারা নিম্ন আয়ের মানুষ। ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক নাজমুন আরা সুলতানা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।