পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ভারতের

যুবা রহমান
০৮ মে ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ভারতের

পেহেলগামে হামলার দুই সপ্তাহ পর জবাব দিল ভারত। মঙ্গলবার রাত স্থানীয় সময় ১টা ৫ মিনিট থেকে দেড়টা পর্যন্ত ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে এই অভিযানে পাকিস্তান ও পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে ৯টি লক্ষ্যে আঘাত হেনেছে ভারত। অভিযান ‘সফল’ বলে দাবি করে ভারত জানিয়েছে, ৭০ জঙ্গি নিহত হয়েছে এবং জঙ্গি আস্তানা ধ্বংস হয়েছে। তবে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছেÑ কোনো জঙ্গি নয়, বরং শিশুসহ ৩১ বেসামরিক লোক নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছে ৫৭ জন। এদিকে পাকিস্তানের পাল্টা গোলায় ভারতশাসিত কাশ্মীরে ১৫ জন নিহত হয়েছে। পাকিস্তান বলেছে, তারা সময় মতো সঠিক জবাবে দেবে। ইতোমধ্যে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে হামলার ‘অনুমোদন’ দেওয়া হয়েছে। এই চরম উত্তেজনার মধ্য দিয়ে পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন দুই বৈরী প্রতিবেশী সর্বাত্মক যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়াল। খবর এনডিটিভি, ডন, বিবিসি ও আল জাজিরা।

পেহেলগামে ২২ এপ্রিল সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জনকে গুলি করে হত্যার পর থেকেই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ছিল। জঙ্গি হামলায় ইন্ধনের জন্য পাকিস্তানকে সরাসরি দায়ী করেছে ভারতÑ যদিও পাকিস্তান তা অস্বীকার করেছে। এ নিয়ে দুই দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে ডজনখানে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। কাশ্মীর সীমান্তেও প্রতিদিনই গোলাগুলি হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি এখানেই থেমে থাকেনি। ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল। 

‘অপারেশন সিঁদুর’ বিষয়ে ভারত জানিয়েছে, ৯টি স্থানে হামলা চালানো হয়েছে, কিন্তু কোনো পাকিস্তানি বেসামরিক, অর্থনৈতিক এমনকি পাকিস্তানের কোনো সামরিক ঘাঁটি টার্গেট করা হয়নি। অভিযানে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়াবা এবং জইশ-ই-মোহাম্মদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও দাবি করে ভারত। এদিকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বিবৃতিতে জানিয়েছে, ৬টি ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন অস্ত্র দিয়ে ২৪ দফা হামলা করেছে ভারত। এতে ২৬ বেসামরিক নিহত ও ৪৬ জন আহত হয়েছেন। একই সঙ্গে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী দাবি করেছেÑ ভারতের তৎপরতা আঁচ করতে পেরে দ্রুতই প্রতিক্রিয়া জানায় পাকিস্তান। এতে ৫টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয় বলে এক বিবৃতিতে বরা হয়। এতে ৩টি রাফাল যুদ্ধবিমান ও একটি মিগ-২৯ রয়েছে। তবে ভারতের পক্ষ থেকে ৩টি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের কথা স্বীকার করা হয়েছে। এ ছাড়া নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার এবং চেকপোস্ট ধ্বংস করা হয়েছে। 

পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরের বাসিন্দারা জানিয়েছে, ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দে তাদের ঘুম ভেঙেছে। বিবিসির স্থানীয় সংবাদদাতা বারামুল্লাহ জেলার সদর হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন। ভারতের হামলায় আহত বেশ কয়েকজনের ছবি প্রচার করেছে বিবিসি। ১৮ বছর বয়সী মনজুর তার বাড়ির প্রথম তলায় ঘুমাচ্ছিলেন। জানলা দিয়ে স্পিøন্টার এসে তার হাতে আঘাত করে। চিকিৎসকরা বলেছেন তার অস্ত্রোপচার করতে হবে। বদরদিন নায়েক এবং তার পরিবারের দুই সদস্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। নায়েকের আট বছরের ছেলের মাথায় আঘাত পেয়েছেÑ তার অস্ত্রোপচার প্রক্রিয়া চলছিল। দুই দেশের কাশ্মীরের বাসিন্দারা সীমাহীন দুর্দশার মধ্যে পড়েছে।

পাকিস্তানে জরুরি বৈঠক

ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির (এনএসসি) জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ। বৈঠকের পর বিবৃতিতে জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করে বলা হয়, পাকিস্তানের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে এবং বেসামরিক প্রাণহানি এবং সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ‘পছন্দমতো সময় স্থান ও কৌশলের’ ভিত্তিতে ভারতকে জবাব দেওয়া হবে। একই সঙ্গেÑ ‘প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ’ গ্রহণের জন্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে ‘সম্পূর্ণ অনুমোদন’ দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার বলেছেন, ভারত আমাদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে। এই হামলা অন্যায্য এবং অবশ্যই অন্ধ আগ্রাসন।

মাসুদ আজহারের পরিবারের ১০ সদস্য নিহত  

ভারতের অভিযানে মাসুদ আজহারের পরিবারের ১০ সদস্য ও ৪ সহযোগী নিহত হয়েছেন। পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুরে মসজিদে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে তারা নিহত হন। গতকাল জইশ-ই-মোহাম্মদ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে মাসুদের বড় বোন ও তার স্বামী, তার ভাগ্নে এবং তার স্ত্রী, এক ভাগ্নি ও তার পরিবারের পাঁচ সন্তান রয়েছে। প্রসঙ্গত, জাতিসংঘ মাসুদ আজহারকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্রের সদস্য মনে করে।

 চীনকে অবগত করল পাকিস্তান

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ ইসহাক দার ভারতের হামলা সম্পর্কে গতকালই চীনের রাষ্ট্রদূত জিয়াং জাইদংকে অবহিত করেছেন। ইসহাক দারের কার্যালয় থেকে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিনা উসকানিতে ভারত পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে এবং নিরীহ মানুষের প্রাণহানি করেছে। বিবৃতিতে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় অঙ্গীকার করা হয়েছে। এর আগে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলাকে ‘দুঃখজনক’ বলে বর্ণনা করেছেন। প্রসঙ্গত, ভারতের যুদ্ধবিমান রাফালের সমকক্ষ চীনের তৈরি জে-১০ যুদ্ধবিমান রয়েছে পাকিস্তানের। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তান চীনের যুদ্ধবিমানের সক্ষমতা পরীক্ষা করতে পারে।

৫৫০ ফ্লাইট বাতিল

এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ভারত ও পাকিস্তানের প্রায় ৫৫০টি নির্ধারিত ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। ফ্লাইট ট্রেকিং পরিষেবা ফ্লাইটট্রেডার২৪ জানিয়েছেন, ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর পাকিস্তানে নির্ধারিত বাণিজ্যিক ফ্লাইটের ১৬ শতাংশ এবং ভারতের ৩ শতাংশ বাতিল করা হয়েছে। এই হিসেবে পাকিস্তানে ১৩৫টি এবং ভারতে ৪১৭টি নির্ধারিত ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। তবে গতকাল দিনের শেষভাগে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে তাদের বিমান চলাচল পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়েছে।

ঘরবাড়ি ছাড়ছে কাশ্মীরের বাসিন্দারা 

পাকিস্তান ও ভারতশাসিত কাশ্মীরের বাসিন্দারা নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে। লাইন অব কন্ট্রোলের দুই এলাকা প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে। বিবিসি জানিয়েছে, বাসিন্দারা জরুরি জিনিসপত্র নিয়ে যে যেভাবে পারে নিরাপদ এলাকা ছেড়ে যাচ্ছেন। বেশ কয়েকজনকে ঘোড়ার গাড়ি করেও যেতে দেখা গেছে। এ ছাড়া দুই দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও নির্ধারিত পরীক্ষা স্থগিত করেছে।

এদিকে ভারত-পাকিস্তানের চরম উত্তেজনা নিয়ে গোটা বিশ^ দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস দুই পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের ভার বহন করতে পারবে না বিশ^। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের অভিযানকে ‘লজ্জাজনক’ বলে বর্ণনা করেছেন। পাশাপাশি তিনি হতাশাও ব্যক্ত করেন। এ ছাড়া বিশে^র বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন বলে জানিয়েছেন।

স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তান বৈরী প্রতিবেশীতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সংঘাত লেগেই রয়েছে। দুই দেশেরই সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। কাশ্মীরে যে কোনো জঙ্গি হামলার জন্য ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে। অন্যদিকে বরাবর পাকিস্তান তা অস্বীকার করে আসছে।