আইসিইউতে চামড়া শিল্প

আব্দুল্লাহ কাফি
০৫ মে ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
আইসিইউতে চামড়া শিল্প

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত, মিথ্যা আশ্বাস ও গোঁয়ার্তুমির কারণে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর রপ্তানি খাত চামড়া শিল্পের অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ওই সরকারের উদ্যোগে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তর করে সরকার। ওই সময় নানারকম আশ্বাসের বাণী শোনানো হলেও প্রকৃতপক্ষে ট্যানারি শিল্পকে রক্ষায় কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। এতে করে চরম ফাঁদে পড়েন উদ্যোক্তারা। পরিস্থিতি উত্তরণে তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোতে ধর্নার পর ধর্না দিয়ে যান। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। সরকারের মিথ্যা আশ্বাসে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে পথে বসেন। কেউ কেউ ঋণখেলাপি হয়ে ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। সেই পরিস্থিতির উত্তরণ আজও হয়নি। উপরন্তু মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শূল্ক নীতি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চামড়া শিল্প এখন আইসিইউতে আছে। শিগগিরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া না হলে এ শিল্পকে বাঁচানো যাবে না। এ থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটবে, আদৌ উত্তরণ সম্ভব কিনা- এ নিয়ে এখন যারপরনাই চিন্তিত খাত সংশ্লিষ্টরা। অনেকেই বলছেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের ‘ভারতপ্রীতি‘র জেরেই এ অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে। কারণ, এতে করে ভারতের চামড়াশিল্পের বাণিজ্য বিকশিত হয়েছে।

সাভারের হেমায়েতপুরে ট্যানারি স্থানান্তরে ব্যবসায়ীদের বাধ্য করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার। কিন্তু সেখানে চামড়ানগরীর অবকাঠামোগত উন্নয়নকাজ আজও হয়নি। এখনও কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) কাজ শেষ না হওয়ায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এ কারণে কোনো ট্যানারি কমপ্লায়েন্সও হচ্ছে না। আর নন-কমপ্লায়েন্স হওয়ার কারণে চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন ও মান নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদও মিলছে না। দেশে এলডব্লিউজির সনদপ্রাপ্ত ট্যানারি রয়েছে সাকুল্যে মাত্র পাঁচটি। এগুলো হচ্ছে- রিফ (আরআইএফএফ) লেদার লিমিটেড, এসএএফ (সাফ) ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, এপেক্স ফুটওয়্যার, এবিসি লেদার ও সুপারেক্স লেদার। এ ছাড়া দেশের আর কোনো ট্যানারি এলডব্লিউজি সনদ পায়নি। আর এই পাঁচটির মধ্যে পূর্ণ কমপ্লায়েন্স রয়েছে মাত্র দুটির। এসব প্রতিষ্ঠানই কেবল বৈশি^ক মানের সুবিধা পাচ্ছে। এ কারণে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর চামড়া কেবল চীন ছাড়া বিশ্বের কোথাও রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না।

উদ্যোক্তারা বলছেন, অবকাঠামো নির্মাণ না করে হাজারীবাগ থেকে চামড়া ব্যবসায়ীদের সাভারে বলপূর্বক নিয়ে যাওয়া হয়। সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে সিইটিপি ঠিক না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় ৭০-৮০ শতাংশ কম দামে চামড়া রপ্তানি করতে হচ্ছে। তারা বলছেন, বিগত সরকারের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত ও গোয়ার্তুমির কারণেই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত। এ কারণে সুদ মওকুফ করে ঋণ রিশিডিউলেরও দাবি জানিয়েছেন তারা।

এদিকে বিশ্ববাজারে চাহিদা না থাকায় ধারাবাহিকভাবে কমছে রপ্তানি; দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে বাজার। এ কারণে গত বছরের প্রায় ৩০ লাখ পিস চামড়া এখনও গুদামে পড়ে আছে, যা মোট চামড়ার অর্ধেকেরও বেশি। দিন দিন লোকসানের পাল্লা ভারি হচ্ছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে না পারায় প্রায় ৯০ শতাংশ ট্যানারি মালিক ঋণখেলাপি হয়ে গেছেন।

ফিনিশড লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন আমাদের সময়কে বলেন, চামড়া শিল্প এখন আইসিইউতে আছে। একে বাঁচাতে হলে দীর্ঘমেয়াদি নীতি সহায়তা প্রয়োজন। তিনি বলেন, সিইটিপি অসম্পূর্ণ থাকার কারণে বর্তমানে আন্তর্জাতিক যে বাজার দর আছে, আমরা সেই তুলনায় ৭০-৮০ শতাংশ কম দামে চীনে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। আমরা যদি এটার ভ্যালু এডিশন বাড়াতে পারি, তাহলে আগের দামে চামড়া কিনতে পারতাম।

মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিসিক শিল্প নগরিতে ট্যানারি মালিকদের যে অংশগ্রহণ সেটা যথার্থই ছিল। ব্যর্থ যেটা হয়েছে, সেটা সরকারি প্রতিষ্ঠান বিসিকের কারণেই হয়েছে। কাজেই ব্যর্থতার দায় কোনো অবস্থাতেই ট্যানারি মালিকদের ওপর বর্তায় না।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, এবার পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। কারণ, আগে চীনের কাছে কম দামে রপ্তানি হলেও এখন চীনও সমস্যায়। তাই ওরা দাম আরও ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে চাইবে। এতে সংকট আরও বাড়বে। এ ছাড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যয়ও আগের চেয়ে বেড়ে যাবে। এর কারণ হচ্ছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি লবণের দাম বেড়েছে সাড়ে তিন টাকা। এ ছাড়া গরমে চামড়া পচে যাওয়ার আশঙ্কা তো রয়েছেই। তিনি বলেন, এ খাতের উদ্যোক্তারা ঋণের জালে জর্জরিত। কোরবানির সময় ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার চাহিদা থাকে। সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা না করলে ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনতে পারেন না।

শাহীন আহমেদ বলেন, এ ক্ষেত্রে এ খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ পরিশোধে দীর্ঘমেয়াদি সময় দিতে হবে। পাশাপাশি নতুন করে ঋণ দিতে হবে যেন এ শিল্প ফের ঘুরে দাঁড়াতে পারে।

জানা গেছে, আন্তর্জাতিক সনদ পাওয়া কারখানাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ভালো রপ্তানি করছে। দেশটিতে বছরে ৮ থেকে ১০ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়। এ ছাড়া চামড়া সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পণ্য যেমন স্যুটকেস, হ্যান্ডব্যাগ, অ্যাকসেসরিজ ইত্যাদি মিলিয়ে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ২৭ কোটি ডলারের পণ্য।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত বছর কোরবানির পর চামড়ার বাজারে একটি গরুর কাঁচা চামড়ার দাম তার আগের বারের তুলনায় ঢাকায় ৫০-১০০ টাকা বৃদ্ধি পায়। এর পরও সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে কমপক্ষে ২৭৫-৩০০ টাকা কমে বিক্রি হয়েছে একেকটি চামড়া। ঈদের দিন পুরান ঢাকার পোস্তায় বড় ও মাঝারি আকারের গরুর কাঁচা চামড়া সর্বোচ্চ ৮০০-৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ঢাকার বাইরে দাম ছিল আরও কম। অথচ ২০১৫-১৬ সালে একেকটি চামড়া গড়ে ২ হাজার টাকারও বেশি দামে বিক্রি হতো। অন্যদিকে ছাগলের চামড়া কিনতে এখন রীতিমতো অনীহা দেখাচ্ছেন আড়তদাররা। গত বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার ছাগলের চামড়া ভাগাড়ে ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

জানা গেছে, ১৯৫১ সালের ৩ অক্টোবর এক গেজেটের মাধ্যমে ভূমি অধিগ্রহণ করে সরকার নারায়ণগঞ্জ থেকে চামড়াশিল্পকে ঢাকার হাজারীবাগে এনেছিল। তবে সেখানে বর্জ্য শোধনের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে প্রতিদিন প্রায় ২৪ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য নালা দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে পড়ত। রাস্তার পাশে ও ডোবায় ফেলা হতো কঠিন বর্জ্য।

পরিবেশ দূষণ রোধে ২০০৩ সালে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প নগর প্রকল্প নেওয়া হয়। ব্যয় ধরা হয় ১৭৬ কোটি টাকা। পরে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারসহ নানা খাতে ব্যয় বাড়িয়ে মোট প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকায়। সিইটিপি নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০১২ সালে। সেটি নির্মাণের পর পুরোপুরি চালু না করেই ২০১৭ সালে কোরবানির ঠিক আগে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প হেমায়েতপুরে স্থানান্তর করা হয়।

হেমায়েতপুর সিইটিপির তরল বর্জ্য পরিশোধনের সক্ষমতা দৈনিক ২৫ হাজার ঘনমিটার। তবে ট্যানারিগুলো পুরোদমে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করলে সিইটিপির সক্ষমতার চেয়েও অনেক বেশি বর্জ্য উৎপাদন হয়। অন্যদিকে, পরিশোধিত তরলে এ পর্যন্ত ক্লোরাইড ও বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (বিওডি) নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আনা যায়নি।

ট্যানারি মালিকরা বলছেন, চামড়াশিল্প নগরের সিইটিপি ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখনও অসম্পূর্ণ। কোরবানির পর বাড়তি চাপ নিয়ন্ত্রণে রেশনিং করে চামড়া প্রক্রিয়াজাতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত বছরও এভাবে করা হয়েছিল। তাতে দূষণ বন্ধ হয়নি, কেবল মাত্রা কমেছিল।

এদিকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার জানিয়েছেন, এবার ২০ লাখ কোরবানির পশু উদ্বৃত্ত থাকবে, কোরবানির পশু আমদানি করা লাগবে না। এ বছর কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর মধ্যে ৫৬ লাখ ২ হাজার ৯০৫টি গরু-মহিষ, ৬৮ লাখ ৩৮ হাজার ৯২০টি ছাগল-ভেড়া ও ৫ হাজার ৫১২টি অন্যান্য প্রজাতিসহ সর্বমোট ১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৭টি গবাদি পশুর প্রাপ্যতা আশা করা যাচ্ছে।