ব্যাংকগুলোর সুদ স্থগিত হিসাবে আটকা ৭৫ হাজার কোটি টাকা
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিতরণ হওয়া ঋণ দ্রুত মন্দমানের খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। আর এই মানের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলোর সুদ স্থগিত হিসাবে আটকে গেছে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে গত এক বছরে সুদ আয় স্থগিতের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় পৌনে ১৮ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি সুদ আয় স্থগিত রয়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর। এর পরই আছে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণ শুধু ব্যাংকের আয়েই প্রভাব ফেলছে না, এর ফলে তাদের বিনিয়োগ সক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। কারণ, ঋণের গুণগত মান অনুযায়ী প্রত্যেকটি ব্যাংকে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে।
নিয়ম অনুযায়ী ঋণ শ্রেণিকরণের তিনটি ধাপ রয়েছে। খেলাপি হওয়ার পর তিন মাস থেকে ছয় মাস পর্যন্ত নিম্নমান, ছয় মাস থেকে ১২ মাস পর্যন্ত সন্দেহজনক এবং ১২ মাসের বেশি সময় খেলাপি থাকলে তা মন্দ ঋণ বা আদায় অযোগ্য ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই তিনটি পর্যায় বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে হয়। এর মধ্যে নিম্নমান ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ, সন্দেহজনকের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দমান বা ক্ষতিজনক ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়। খেলাপি ঋণ বাড়লে আর সে অনুযায়ী ব্যাংকের আয় না হলে প্রভিশন ঘাটতি দেখা দেয়। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী প্রভিশন ঘাটতি থাকলে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না সংশ্লিষ্ট ব্যাংক।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংকগুলোর আয়ের মূল উৎস হলো বিতরণ করা ঋণের সুদ আয়। কিন্তু কোনো ঋণ যখন মন্দমানে খেলাপি হয়ে পড়ে, তখন সেই ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ আয় খাতে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধিনিষেধ রয়েছে। ব্যাংক খাতে এ রকম প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকার সুদ আয় স্থগিত করে রাখা হয়েছে। প্রকৃত আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই সুদ আয় খাতে নিতে পারবে না ব্যাংকগুলো।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, মন্দ ঋণ বাড়লে ব্যাংকগুলো সবদিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ ছাড়াও ওই ঋণের বিপরীতে চার্জ করা সুদ আয় খাতে নিতে পারে না। আমানতকারীদের স্বার্থেই এই বিধিনিষেধ দেওয়া আছে। যদি এই বিধিনিষেধ দেওয়া না হতো তাহলে প্রকৃত আদায় ছাড়াই ব্যাংকগুলো এই সুদ আয় খাতে নিয়ে লভ্যাংশ হিসেবে বের করে নিতো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। এর মধ্যে মন্দমানে খেলাপি হয়েছে ২ লাখ ৯১ হাজার ৫৩৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এটি মোট খেলাপি ঋণের ৮৪ দশমিক ৩১ শতাংশ। এই ঋণের বিপরীতে গত বছর শেষে ব্যাংকগুলোর সুদ স্থগিত বাবদ আটকে রয়েছে প্রায় ৭৪ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে ব্যাংক খাতে মন্দ ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৬ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। এর বিপরীতে সুদ স্থগিত বাবদ আটকে ছিল ৫৭ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। ফলে এক বছরে সুদ স্থগিত হিসাবে আটকে থাকা তহবিল বেড়েছে প্রায় ১৭ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
প্রতিবেদনে দেখা যায়, মন্দ ঋণের আধিক্য বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংকে। গত ডিসেম্বর শেষে এসব ব্যাংকে মন্দ ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোর সুদ আয় স্থগিত বাবদ আটকে রয়েছে প্রায় ৩১ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৬০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা মন্দ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর সুদ স্থগিতের পরিমাণ ছিল ২৬ হাজার ৪১ কোটি টাকা। ফলে এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকগুলোর সুদ স্থগিতের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৫ হাজার ৯০ কোটি টাকা। এ সময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় মন্দ ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোর সুদ স্থগিত রয়েছে ৪১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। ২০২৩ সাল পর্যন্ত এ খাতের ব্যাংকগুলোর ৫৮ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা মন্দ ঋণের বিপরীতে সুদ স্থগিতের পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা। ফলে গত বছর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সুদ স্থগিতের পরিমাণ বেড়েছে ১২ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা। অন্যদিকে এ সময়ে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে মন্দ ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণ রয়েছে ২ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা। এ দুই খাতের ব্যাংকের গত বছর শেষে সুদ স্থগিতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৪০০ কোটি টাকা ও ২ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা। ২০২৩ সাল পর্যন্ত তাদের সুদ স্থগিতের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৪২৮ কোটি টাকা ও ১ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। এর মানে গত বছর শুধু বিশেষায়িত খাতের ব্যাংকগুলোর সুদ স্থগিতের পরিমাণ ২৮ কোটি টাকার মতো কমেছে। অর্থাৎ, এই পরিমাণ সুদ প্রকৃত আদায় সাপেক্ষ তারা আয় খাতে নিতে পেরেছে।