কমাতে গিয়ে আরও বেড়েছে গ্যাস সেবার জটিলতা

লুৎফর রহমান কাকন
২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
কমাতে গিয়ে আরও বেড়েছে গ্যাস সেবার জটিলতা

দেশের অর্থনীতির গতি সঞ্চার ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কোনো বিকল্প নেই। বিগত সময়গুলোতে গ্যাসের নতুন সংযোগ, লোড বৃদ্ধি, কারখানার যন্ত্রাংশের পুনর্বিন্যাসে শিল্প মালিকদের ভোগান্তির শেষ ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এসেও এ থেকে বেরিয়ে আসা যায়নি। বরং ক্ষেত্রবিশেষে জটিলতা আরও বেড়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিল্প মালিক আমাদের সময়কে জানিয়েছেন, শিল্পকারখানায় গ্যাসের লোড বৃদ্ধি, নতুন সংযোগসহ নানা জটিলতার সমাধান আগে গ্যাস কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদই দিতে পারত। তদবিরের মাধ্যমে কোনো না কোনো উপায়ে দ্রুত কাজ আদায় করিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু এখন সেগুলো প্রায় বন্ধই রয়েছে। বর্তমানে বকেয়াসহ কোনো কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে নতুন করে সংযোগ পেতে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতায় পড়তে হচ্ছে। অনেক সময় এত দীর্ঘ সময় লাগছে যে, কারখানা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে।

একাধিক ব্যবসায়ী বলেছেন, অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা যাচ্ছে, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো আন্দাজের ওপর নির্ভর করে শিল্পকারখানার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে কোম্পানি যে ভুল করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে, সেটা প্রমাণ করতেই বছর লেগে যাচ্ছে। অথচ এর মধ্যেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় শিল্প প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তারা বলছেন, শিল্পকারখানার গ্যাস সংযোগ প্রদান তথা গ্যাস-সেবার বিষয়ে ওয়ান স্টপ সার্ভিস করা হচ্ছে না।

তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেন, এখন কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অন্য একটি মন্ত্রণালয়ের সচিবকে। অথচ কোম্পানির যাবতীয় দায়বদ্ধতা জ্বালানি বিভাগের সচিবের কাছে। ফলে যে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, আরও এমন কিছু অদৃশ্য জটিলতা তৈরি হয়েছে, যা আসলে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করে বলা কঠিন।

এ কর্মকর্তা মনে করেন, আরও সুচিন্তিত সংস্কার প্রয়োজন। তিনি বলেন, কোম্পানির বোর্ড থাকলেও এর পাশাপাশি এখন একাধিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটির মতামতের ওপর ভিত্তি করে শিল্পকারখানার গ্যাসের যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এতে করে বিষয়টি আরও সময়সাপেক্ষ ও জটিল হয়ে পড়েছে শিল্পমালিকদের জন্য। তিনি বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জ্বালানি উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত কমিটিকে ‘ম্যানেজ’ করতে না পারলে কেউ সংযোগ পায়নি। এখন অনেকটা সে রকমই হয়েছে। নতুন সংযোগ, লোড বৃৃদ্ধিসহ নানা ইস্যুতে তিতাসের বোর্ড সদস্যদের নিয়ে আলাদা করে গঠিত কমিটির মতামত লাগে। অন্যদিকে মন্ত্রণালয় নির্দেশনা জারি করেছে, তাদের না জানিয়ে কোনো কিছু করা যাবে না। ফলে এখন সবকিছুই পড়েছে দীর্ঘমেয়াদি এক জটিলতায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দীর্ঘ জটিলতায় আটকা পড়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে শিল্পকারখানা। সাম্প্রতিক সময়ে নারায়ণগঞ্জের বরিন টেক্স নামে একটি কারখানার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ১০ কোটি টাকা জরিমানা পরিশোধ করার পরও কারখানাটির সংযোগ পেতে সময় লেগেছে প্রায় দুই মাস। গাজীপুরের এমএসসি নিট নামে একটি কারখানার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ৮ কোটি টাকা জরিমানা পরিশোধ করেও সংযোগ পেতে সময় লেগেছে দুই মাস। এ সময় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি ক্রেতাদের অনেকেই অর্ডার ক্যানসেল করে দিয়েছেন।

জ্ব লানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, জ্বালানি উপদেষ্টার ইচ্ছা ছিল, দুর্নীতিমুক্ত সংস্কার করা। শিল্প মালিকদের গ্যাসের সেবা সহজ করা। কিন্তু জ্বালানি বিভাগ, পেট্রোবাংলা ও কোম্পানিগুলোর নানা ধরনের পদেক্ষেপে সেটা আরও জটিল করে তুলেছে। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ক্ষমতা কমে গেছে। ফলে দ্রুত সেবা পাচ্ছেন না শিল্প মালিকরা। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে গিয়ে সেটা আরও কেন্দ্রীকরণ করা হচ্ছে। ফলে যেসব শিল্প মালিকদের পক্ষে কেউ তদবির বা যোগাযোগ কিংবা অনুরোধ করতে পারছেন না, তাদের ফাইল আটকে থাকছে দীর্ঘ সময়।

সম্প্রতি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে ইস্যু করা একাধিক পত্রের প্রেক্ষিতে দেখা যায়, জ্বালানি বিভাগের ইস্যু করা নতুন আদেশের ফলে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো আরও বেশি অকার্যকর হয়ে পড়েছে। মূলত তাদের আর কোনো ক্ষমতাই থাকছে না।

সর্বশেষ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের ২১ এপ্রিল ইস্যু করা এক চিঠিতে শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণিতে নতুন গ্যাস সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে পূর্বানুমতি গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ১৬ এপ্রিল সভার রেফারেন্স দিয়ে লেখা চিঠিতে শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণিতে নতুন গ্যাস সংযোগ প্রদানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এসব নির্দেশনায় জরুরি প্রয়োজনে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে কেস টু কেস ভিত্তিতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের পূর্বানুমতি সাপেক্ষে গ্যাস সংযোগ প্রদান করা যেতে পারে। বিষয়টি সব গ্যাস বিপণন ও বিতরণ কোম্পানিকে অবহিত করার জন্য পেট্রোবাংলা নির্দেশ দেওয়া হয়।

এর আগে গত ১৬ এপ্রিল উপসচিব রুবায়েত খান ৫ দফা নির্দেশনা দিয়ে একটি চিঠি ইস্যু করেন। এতে বলা হয়, গ্যাস সংযোগ প্রদানের আবেদন বিবেচনার ক্ষেত্রে আবেদনগুলো নতুন সংযোগ, লোড বৃদ্ধি এবং প্রতিশ্রুত- এই তিন ভাগে বিভক্ত করতে হবে। এরপর গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো কর্তৃক গ্যাসের পর্যাপ্ততা বিবেচনায় নিয়ে একটি অগ্রাধিকার তালিকা প্রস্তুত করে জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলায় প্রেরণ করতে হবে। নতুন সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রাহকের গ্যাস প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। নতুন সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে প্রধান উদ্দেশ্য হবে রাজস্ব বৃদ্ধি করা। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি সংযোগের অর্থনৈতিক প্রভাব পর্যালোচনা করতে হবে। শিল্প শ্রেণিতে নতুন সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে পরিকল্পিত শিল্পাঞ্চল ও রপ্তানিমুখী শিল্পকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এরূপ নতুন সংযোগ অথবা লোডবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে যে অতিরিক্ত গ্যাস বরাদ্দ প্রয়োজন হবে তা নিরূপণ করে যথাসময়ে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

প্রথম দফার চিঠিতে কিছুটা ধোঁয়াশা থাকলেও পরের চিঠিতে গ্যাস সংযোগের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতির বিষয়টি স্পষ্ট করে দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলছেন, তাহলে বিতরণ কোম্পানিগুলোর যে বিশাল জনবল এবং জোনভিত্তিক অফিস, তারা কী করবেন? তারা কী কেবল মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করবেন? হাজার হাজার শিল্পকারখানার প্রতিদিনের শত শত ইস্যুর সমাধান কীভাবে হবে? এ ছাড়া কোম্পানির বোর্ডই বা কী করবে?

এদিকে শুধু মন্ত্রণালয় বা তিতাসের বোর্ড নয়, জটিলতা রয়েছে আরও অনেক। শিল্প মালিকদের লাইসেন্সসহ নানা ইস্যুতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনেও (বিইআরসি) দৌড়াতে হয়। সঙ্গতকারণেই ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে দিন দিন ব্যবসা করার অবস্থা জটিলতর হয়ে পড়ছে।

জ্বালানি বিভাগ থেকে প্রথম দফায় ইস্যু করা চিঠির পঞ্চম দফায় বলা হয়েছে, নতুন সংযোগ অথবা লোড বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে যে অতিরিক্ত গ্যাস বরাদ্দ প্রয়োজন হবে, তা নিরূপণ করে যথাসময়ে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

বাস্তবতা হচ্ছে, গ্যাস সংযোগের সঙ্গে এলএনজি আমদানির বিষয়টি পুরোপুরি সম্পৃক্ত নয়। এলএনজি আমদানি নির্ভর করে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের ওপর। গ্যাসের ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতেই দেশে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। ফলে নতুন সংযোগের সঙ্গে এখনই এলএনজি আমদানির ইস্যু সমৃক্ত নয়। এ ছাড়া চাহিদা অনুযায়ী এলএনজি আমদানির সক্ষমতা এ মুহূর্তে দেশের নেই। এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি এলএনজি আমদানি করতে হলে অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে নতুন করে।

দেশে বিদ্যমান শিল্পকারখানা চুক্তি অনুযায়ী গ্যাস পায় না। অর্ধেকের বেশি এখনও ঘাটতি রয়েছে। প্রতিশ্রুত গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ করতে হলে দৈনিক আরও ২৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি করা দরকার। যদিও পেট্রোবাংলার ভাষ্য, গ্যাসের প্রকৃত চাহিদা ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। তাদের হিসাব যথার্থ ধরা হলেও প্রতিদিন ঘাটতি থেকে যায় প্রায় ১৩শ মিলিয়ন ঘনফুট। পূর্ণ সক্ষমতায় এলএনজি আমদানি করলে সরবরাহ বাড়বে মাত্র ৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো।

এসব বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান রেজানুর রহমান ইতোমধ্যে গণমাধ্যমকে বলেছেন, কারও ক্ষমতা খর্ব করার জন্য নয়, মনিটর বাড়ানোর জন্যই নানা কমিটি করা হয়েছে।

বিতরণ কোম্পানিগুলোর সূত্র জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্যাসের সংযোগ, লোড বৃদ্ধি, বকেয়ার জন্য সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে দ্রুত সংযোগ দেওয়ার তদবির বেড়েছে। ফলে অনেক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজেও চান যেন তাদের ওপর তেমন কোনো দায়িত্ব না থাকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, আমি চাই মন্ত্রণালয় বা বোর্ড সব দায়িত্ব নিয়ে নিক। কারণ তদবির সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, নির্বাহী আদেশে এই কাজগুলো করা সমীচীন হচ্ছে না। কর্তৃত্বগুলো স্বচ্ছ হওয়া দরকার। কোম্পানিগুলো বোর্ড সংশ্লিষ্ট ও দক্ষ লোক দিয়ে গঠন করা দরকার। তিনি বলেন, এক মন্ত্রণালয়ের আমলা বাদ দিয়ে আরেক মন্ত্রণালয়ের আমলা দিয়ে বোর্ড গঠন করে কি লাভ হচ্ছে, বুঝতে পারছি না। ঘটনা তো একই থেকে যাচ্ছে। এগুলো কোনো সংস্কার না। তিনি বলেন, যতটা সম্ভব ব্যবসাবান্ধব করতে হবে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোকে। এখন তো মনে হয় সরকারি কর্মকর্তা, গ্যাস বিতরণ কোম্পানির কর্মকর্তারা রাজা। আর ব্যবসায়ীরা যেন তাদের দয়ায় চলছেন।