সিস্টেম লস কমিয়ে গ্যাস সংকটের সমাধানে জোর

লুৎফর রহমান কাকন
১৭ এপ্রিল ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
সিস্টেম লস কমিয়ে গ্যাস সংকটের সমাধানে জোর

চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত গ্যাসের সরবরাহ নেই। গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যমান শিল্পকারখানা সক্ষমতা অনুযায়ী চলছে না। নতুন বিনিয়োগও স্থবির। কারখানাগুলো তাদের প্রয়োজনীয় লোড বৃদ্ধি করতে পারছে না। দেশীয় উৎসের গ্যাসের সঙ্গে এলএনজি আমদানি করে সংকট সামাল দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত থাকলেও অর্থ ও ডলার সংকটের কারণে সেটাও পুরোপুরি সম্ভব হচ্ছে না। একদিকে বিপুল ব্যয়ে আমদানি করা গ্যাস বিক্রি করে লোকসান দিচ্ছে সরকার; অন্যদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এত খরচ করে ব্যয়বহুল গ্যাস সরবরাহ করা হলেও তাতে ঘটছে চুরি, পাইপলাইনে ছিদ্র; যাকে বলা হয় সিস্টেম লস। এর মধ্যে নিয়মিত বিল আদায়ও হচ্ছে না। এ অবস্থায় এখন গ্যাসের সিস্টেম লস কমিয়ে লোকসান কমাতে তৎপরতা চালাচ্ছে সরকার। জ¦ালানি বিভাগ ইতোমধ্যে গ্যাসের সিস্টেম লস কমিয়ে এনে গ্যাসের অপব্যবহার রোধ করতে নানা কর্মপরিকল্পনা দিয়েছে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোকে। সেগুলো মনিটর করতে রয়েছে নানা কমিটি। ইতোমধ্যে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে বলেও মনে করছে জ্বালানি বিভাগ।

জ্বালানি বিভাগ সূত্র বলছে, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী গ্যাসের সিস্টেম লস কমিয়ে আনার অব্যাহত চেষ্টা করছে কোম্পানিগুলো। সিস্টেম লস কমাতে জ্বালানি বিভাগের পরিকল্পনা অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি মাসে সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলো যার যার লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কিছুটা সক্ষম হয়েছে। ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে সিস্টেম লস ৪ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে।

গতকাল বুধবার সচিবালয়ে গ্যাসের সিস্টেম লস হ্রাসসংক্রান্ত এক সভায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. ফাওজুল কবির খান এতে সভাপতিত্ব করেন।

সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর ফেব্রুয়ারি মাসের সিস্টেম লসের পরিসংখ্যান সভায় তুলে ধরা হয়। এতে দেখা গেছে, সর্ববৃহৎ বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাসের জানুয়ারি মাসে সিস্টেম লস ছিল ১০.৫৩ শতাংশ, যা ফেব্রুয়ারি মাসে ৯.২১ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে অঞ্চলভেদে কোম্পানিটির সিস্টেম লস ২০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির জানুয়ারি মাসে সিস্টেম লস ছিল ১৩.৬০ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি মাসে ১১.৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য থাকলেও তারা ৯.৪৭ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিতরণের দায়িত্বে থাকা কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ৪.৬০ শতাংশ থেকে ২.৫৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।

একমাত্র সঞ্চালন কোম্পানি জিটিসিএল জানুয়ারি মাসে লোকসান দিয়েছে ২.২৩ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি মাসে কোম্পানিটি ১.১৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে সামগ্রিক সিস্টেম লস দাঁড়িয়েছে ৯ শতাংশে। ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে এই লোকসান অর্ধেকের নিচে নামিয়ে আনতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সিস্টেম লস কমানোর ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জে রয়েছে সবচেয়ে বড় ?ও পুরাতন কোম্পানি তিতাস গ্যাস। কোম্পানিটি একদিকে যেমন অবৈধ সংযোগের সঙ্গে পাল্লা দিতে হচ্ছে, একই সঙ্গে হাজার হাজার কিলোমিটার মেয়াদোত্তীর্ণ জরাজীর্ণ পাইপলাইনের সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। পাইপলাইনের লিকেজ ঠেকাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে কোম্পানিটিকে।

২০২৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪ হাজার ৭০ কিলোমিটার পাইপলাইনে জরিপ পরিচালনা করা হয়। ওই জরিপে ৯ হাজার ৩৮৪টি ছিদ্র পাওয়া গেছে। অর্থাৎ যেখানেই হাত দেওয়া হচ্ছে সেখানেই লিকেজ পাওয়া যাচ্ছে। একই সময়ে জালালাবাদে ১১৮টি জিটিসিএলে মাত্র ২টি লিকেজ, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি মাত্র ১১টি, বাখরাবাদে ৩টি এবং পশ্চিমাঞ্চল গ্যাসে ১টি ছিদ্র চিহ্নিত ও মেরামত করা হয়েছে।

তিতাস গ্যাসের সিস্টেম লস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সমালোচনা হলেও খুব একটা সুফল দেখা যায়নি। তবে এখন পরিস্থিতি কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। কোম্পানিটির সাঁড়াশি অভিযানে সফলতা পেতে শুরু করেছে। চলতি বছরের প্রথম ৩ মাস (জানুয়ারি-মার্চ) ৭৯টি মোবাইল কোর্ট এবং ৪৮৫টি মোবাইল কোর্ট ব্যতীত অভিযান পরিচালনা করেছে, যা একক কোম্পানি হিসেবে রেকর্ড বলা যেতে পারে। অভিযানে ৯১টি অবৈধ শিল্প সংযোগ, ৯০টি বাণিজ্যিক সংযোগ এবং ২৪ হাজার ৫৩৩টি অবৈধ চুলা এবং ৫৪ কিলোমিটার পাইপলাইন উচ্ছেদ করার তথ্য পাওয়া গেছে।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ আমাদের সময়কে বলেন, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে সিস্টেম লস অর্ধেকে নামিয়ে আনার রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা সেভাবেই পদক্ষেপ নিয়েছি। এ সময়ের মধ্যে সিস্টেম লস ৪ শতাংশের মধ্য নামিয়ে আনা হবে। পুরো কোম্পানিকে অঞ্চলভিত্তিক কয়েক ভাগে ভাগ করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা চিহ্নিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে লিকেজ মেরামত করার জন্য জোরালো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, তিতাস গ্যাস কোম্পানিকে নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে প্রতিনিয়ত কাজ করতে হচ্ছে। আমরা মনিটর করছি বিচ্ছিন্নকৃত সংযোগ যেন আবার নতুন করে না লেগে যায়। অবৈধ গ্যাসের ব্যবহার রোধে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। অভিযান বাড়ানো হয়েছে।

বিইআরসির তথ্য অনুযায়ী, গত ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) গ্যাসের সামগ্রিক সিস্টেম লস আগের বছরের তুলনায় ৫ শতাংশ বেড়েছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্যাসের সিস্টেম লস ছিল ৮.৪৩ শতাংশ। যা চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে হয়েছে ১৩.৫৩ শতাংশ। বিশ্বজুড়ে ২ শতাংশের নিচে সিস্টেম লসকে আদর্শ বিবেচনা করা হয়। অনেক আগেই বিইআরসি সিস্টেম লস ২ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দিয়েছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা সিস্টেম লস কমানোর ওপর ব্যাপক জোর দিয়েছেন। তিনি সভায় বলেছেন, আমরা এমনভাবে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি যাতে অর্জন সহজ হয়। যেসব কর্মকর্তা এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সফল হবে তাদের পুরস্কৃত করা হবে, আবার যারা ব্যর্থ হবেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে গ্যাসের নানা সংকটের মধ্যেই নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। দাম বৃদ্ধির গণশুনানিতে বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেছেন, দেশের গ্যাস কমার সঙ্গে সঙ্গে এলএনজি আমদানি বাড়তে থাকে। এলএনজির বাড়তি দাম দিতে গিয়ে চাপে পড়ে পেট্রোবাংলা। তারা ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছিল। তবে বিইআরসি ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়িয়েছে নতুন শিল্পকারখানার জন্য। এ সময় তিনি বলেন, কোম্পানিগুলোকে ‘সিস্টেম লস’ কমাতে বলা হয়েছে। এ নিয়ে তাগাদা দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে সব কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন মূল্যায়ন করা হবে। পেশাদার নিরীক্ষক নিয়োগ করে আয়-ব্যয়ের যথার্থতা যাচাই করা হবে। তিনি বলেন, সিস্টেম লস কমাতে পারলে আর্থিক লোকসান অনেক কমে যাবে।