নির্বাচনী রোডম্যাপ জানতে চাইবে বিএনপি
জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আজকের বৈঠকের পর বিএনপি তার পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করবে। বৈঠক ফলপ্রসূ হলে আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রস্তুতি শুরু হবে। আর অন্য বৈঠকের মতো এবারও সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত না পেলে রাজপথের কর্মসূচিতে যেতে পারে দলটি।
এমন পরিস্থিতি আজ দুপুর ১২টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির বৈঠক বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। এ বৈঠকের পর রাজনীতির গতিপথে কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে বলেও ধারণা করছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
বিএনপি মনে করছে, সংসদ নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে যেসব বক্তব্য আসছে, তাতে পরিষ্কার কোনো বার্তা নেই। বরং নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হচ্ছে জনমনে। নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের ‘ষড়যন্ত্র’ও দেখতে পাচ্ছে দলটি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, নির্বাচন নিয়ে সরকারের বক্তব্য স্পষ্ট নয়। বরং কয়েক দিন পরপরই বিএনপিকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য
দেওয়া হচ্ছে। আবার সরকারের উপদেষ্টারাই বলছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে পাঁচ বছর দেখতে চায় জনগণ। এই ধরনের বক্তব্যে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার ইচ্ছার প্রতিফলন রয়েছে। এ সব বিষয়ে সরকারের কাছে সুস্পষ্ট বক্তব্য জানতে ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক হবে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে গতকাল রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে আজকের বৈঠকের আলোচ্যসূচি নিয়ে কথা হয়। নেতারা নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত আদায় করতে তাদের কৌশল নির্ধারণ করেন।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে ভোট অনুষ্ঠানের যে কথা বলা হচ্ছে তা স্পষ্ট নয়। নির্বাচন নিয়ে সরকারের পক্ষে একেক সময় একেক বক্তব্যে এক ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। তাই নির্বাচন ঠিক কবে হবে কিংবা নির্বাচন নিয়ে সরকারের প্রকৃত অবস্থান কী, ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি নেতারা তা নিয়ে আলোচনা করবেন।
সংস্কার নিয়ে কাজ করছেন বিএনপির এমন এক নেতা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, বিএনপিকে দোষারোপের চক্রান্ত হচ্ছে। বিএনপি ৭২-এর সংবিধানের মূলনীতি পুনর্বহাল চায় বলে যে গুঞ্জন ছড়ানো হয়েছে, তা দলটিকে একদিকে ঠেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে বিএনপি পরিষ্কার করে মতামত দিয়ে বলেছে, ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে সংবিধানে যে চার মূলনীতি ছিল তার পুনর্বহাল চায় বিএনপি।
এর ব্যাখ্যা করে ওই নেতা বলেন, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান বলে ১৯৭৬ সালে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস’কে সংবিধানের মূলনীতি করেন। আরেক মূলনীতি সমাজতন্ত্রের অর্থ করা হয় সামাজিক ন্যায়বিচার। বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে মূলনীতি করেন তিনি। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদে পঞ্চম সংবিধানের সংশোধনীর মাধ্যমে তা অনুমোদন করা হয়। ২০১০ সালে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। পরের বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাহাত্তরের মূলনীতি ফিরিয়ে আনে। অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে বহুত্ববাদকে মূলনীতি করার সুপারিশ করেছে। বিএনপি এতে একমত নয়। বিএনপি ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের অবস্থা অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস’কে ফিরিয়ে আনতে মতামত দিয়েছে। এরপরও বিভ্রান্তি তৈরি করা হচ্ছে। ২০১১ সালের আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া মানেই ১৯৭৯ সালের মূলনীতিতে ফেরা; বাহাত্তরের সংবিধানে নয়।
বিএনপির ওই নেতা বলেন, পরপর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না- বিএনপি তার প্রস্তুাবে এ কথা বলেছে। এ নিয়েও অনেকে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। অথচ এটি বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফাতেই ছিল। অনেকে এখন যা নিয়ে চিন্তা করছেন, বিএনপি তা চিন্তা করেছে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে ঘোষিত ৩১ দফায়। পুলিশ সংস্কার কমিশন বাদে বাকি পাঁচটি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো ছক আকারে দলগুলোর কাছে পাঠিয়ে মতামত চাওয়া হয়েছিল। প্রতিটি সুপারিশের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছিল। প্রথমটি হলো সংশ্লিষ্ট সুপারিশের বিষয়ে একমত কিনা। এতে তিনটি বিকল্প রাখা হয়, ‘একমত’, ‘একমত নই’ এবং ‘আংশিকভাবে একমত’। এ তিনটি বিকল্পের যে কোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত জানাতে বলা হয়েছিল। বিএনপি অধিকাংশ সুপারিশের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। যেখানে ‘আংশিকভাবে একমত’ সেখানে টিকচিহ্ন দেওয়া হয়েছে, পাশাপাশি কেন আংশিকভাবে একমত তার ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। একইভাবে ‘একমত নই’ টিকচিহ্ন দেওয়ার পাশাপাশি কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু একটি বিশেষ গোষ্ঠি বিএনপির যে ব্যাখ্যায় কী বলেছে তা প্রচার না করে ‘একমত নই’ প্রচার করছে। একেবারে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তা করছে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে এসব বিষয় তুলে ধরা হবে। একই সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার কাছে সংস্কার ইস্যুতে কিছু বিষয়ে বিএনপির ব্যাখ্যাও তুলে ধরা হবে।
আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হবে, আশা ফখরুলের : নির্বাচন নিয়ে যে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হচ্ছে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা শেষে সস্ত্রীক হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর টার্মিনালে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা সব সময় বলে এসেছি, আলোচনা ও ঐক্যের মধ্য দিয়ে আমরা একটা নতুন বাংলাদেশ তৈরি করতে চাই। নিঃসন্দেহে এটা সম্ভব হবে এবং আমরা সফল হব। নির্বাচন নিয়ে যে সংকট বা ধোঁয়াশা সৃষ্টি হচ্ছে তা নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এ সমস্যারও সমাধান হবে।
তিন মাসের পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে : ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে সম্প্রতি বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদকদের বৈঠক হয়েছে। সেখানে সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ এবং নির্বাচনের দাবিতে আগামী তিন মাস নানামুখী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার প্রাথমিক পরিকল্পনা করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে থাকতে পারে সভা-সমাবেশ, পদযাত্রা, মিছিল। তৃণমূল থেকে এসব কর্মসূচি শুরু, কয়েকটি ধাপে তা পালিত হবে। এই পরিকল্পনার বিষয়টি লিখিতভাবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, নির্বাচনের দাবিতে ঈদের আগে কর্মসূচি পালিত হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপেও শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ সব কর্মসূচিতে ব্যাপক জনসমাগমের মধ্য দিয়ে বিএনপি এই বার্তা দিতে চাইবে যে, দীর্ঘদিন ধরে দেশের ভোটবঞ্চিত জনগণ এখন গণতন্ত্রে উত্তরণের অপেক্ষায় আছে। তারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে উন্মুখ। এ জন্য জনগণ দ্রুত নির্বাচন চায়। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের ওপর এক ধরনের চাপও সৃষ্টি করতে চায়, যাতে পরিস্থিতির আলোকে সরকারও নির্বাচনের পথে এগোয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিএনপি ঢাকায় বড় ধরনের শোডাউনের চিন্তা করছে। দ্রুত নির্বাচনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত না এলে এ ধরনের কর্মসূচিতে যেতে পারে দলটি। আবার তৃণমূল পর্যায় থেকে কর্মসূচি পালন করে ঢাকায় বড় ধরনের কর্মসূচির কথাও ভাবা হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী