জমকালো বর্ষবরণের প্রস্তুতি

মুহম্মদ আকবর
১০ এপ্রিল ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
জমকালো বর্ষবরণের প্রস্তুতি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা, ছায়ানট, শিল্পকলাসহ সংশ্লিষ্ট সবখানে চলছে বর্ষবরণের বিরামহীন প্রস্তুতি। বর্ষবরণের আয়োজনকে সফল করতে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি চলছে প্রস্তুতিমূলক কাজ। তবে আয়োজনের আঙ্গিকে আসছে পরিবর্তন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের মতে, দীর্ঘ তিন যুগ ধরে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। কিন্তু বর্ষবরণে মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে এদেশের সংস্কৃতির মিল নেই। এ দেশে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা চিন্তা-ভাবনার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। এর নামকরণ পরিবর্তন হতে পারে এমন ইঙ্গিত একাধিকবার দিয়েছেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীও। এ নিয়ে ঢাবি কাজ করছে বলেও জানা গেছে। এটির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে আগামীকাল শুক্রবার। সংবাদ সম্মেলন করে এই সিদ্ধান্ত জানাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকল অনুষদ।

অন্যদিকে গতকাল সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরপর দুটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, বর্ষবরণে ঢাকা এবং ঢাকার আশপাশ থেকে দুই শতাধিক তরুণ মিউজিশিয়ান

গিটার ও ফিলিস্তিনের পতাকা নিয়ে হাজির হবে এই শোভাযাত্রায়। তারা সম্মিলিতভাবে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে গান গাইবে। এদিকে চারুকল অনুষদ থেকে জানানো হয়েছে, নাম পরিবর্তন হোক কিংবা না হোক এবার আয়োজনে প্রাধান্য পাবে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শৈল্পিক প্রতিবাদ।

এদিকে প্রতিবছরের মতো এবারও রমনার বটমূলে সূর্যদোয়ের সঙ্গে বৃন্দ পরিবেশনা নিয়ে থাকবে ছায়ানট। এ বিষয়ে ছায়ানটে অবিরাম মহড়া চলতে দেখা গেছে।

গতকাল দুপুরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বর্ষবরণের বিস্তারিত কর্মসূচির কথা জানান, ১৪ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্র সরোবরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করবে সুরের ধারা। মোট ২৮টি নৃগোষ্ঠী চারুকলায় নববর্ষের শোভাযাত্রায় অংশ নেবে। প্রথমবারের মতো রক মিউজিয়ানদের সংগঠন বামবা এতে অংশ নেবে। ঢাকা ও এর আশপাশ থেকে দুই শতাধিক তরুণ মিউজিশিয়ান গিটার ও ফিলিস্তিনের পতাকা নিয়ে হাজির হবে এই শোভাযাত্রায়। একসঙ্গে তারা গাইবে ‘ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি/ প্যালেস্টাইন উইল বি ফ্রি’। বিকালে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে রয়েছে নববর্ষের অনুষ্ঠান। সন্ধ্যা ৭টায় সেখানে চীনা দূতাবাসের সহযোগিতায় হবে ড্রোন শো।

এ সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথি।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, এ বছর আমরা অল ইনক্লুসিভ একটা নতুন বছর আমরা উদযাপন করতে যাচ্ছি চৈত্রসংক্রান্তিসহ। সব জাতিগোষ্ঠী এটাকে সাদরে গ্রহণ করছে। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতায় যে অনুষ্ঠানগুলো হচ্ছে বা বেসরকারি উদ্যোগেও হচ্ছে। কিন্তু ফ্ল্যাগশিপ অনুষ্ঠান বলতে যা বোঝায়, এবার সেটা হতে যাচ্ছে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথমবার শিল্পকলা একাডেমি চাঁদরাতে অনুষ্ঠান করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সামনে সারাদেশে হবে। শুধু মুসলমানদের উৎসব নয়, অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসবগুলোও দেশব্যাপী হবে। এরপর পাহাড় থেকে সমতল, সারাদেশ ও ঢাকার চৈত্রসংক্রান্তিতে কী কী আয়োজন তা সংক্ষেপে তুলে ধরেন ফারুকী। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উৎসবগুলো চৈত্রসংক্রান্তি ঘিরে হয়। তাই আমাদের উৎসবটাও এবার চৈত্রসংক্রান্তি থেকে শুরু হচ্ছে। শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে দেশের ১২ জেলায় সাধুমেলা হচ্ছে। সেখানে সাধুসঙ্গ ও আধ্যাত্মিক গানের অনুষ্ঠান হবে।

চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে ঢাকা শহরে শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে কনসার্ট হচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সেখানে গান গাইবে গারো সম্প্রদায়ের ব্যান্ড এফ মাইনর, মারমা সম্প্রদায়ের লা রং, ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ইমাং, খাসিয়া সম্প্রদায়ের ইউনিটি, চাকমা সম্প্রদায়ের ইনভোকেশন, বাঙালির মাইলস, ওয়ারফেজ, ভাইকিংস, অ্যাভয়েড রাফা, দলছুট, স্টোনফ্রি।

এর আগে বেলা ১২টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সভাকক্ষে ছিল আরও এক সংবাদ সম্মেলন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন একাডেমির ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ও শিল্পকলা একাডেমির সচিব ওয়ারেছ হোসেন, সব পরিচালক ও উপ-পরিচালক, ফিডব্যাকের ফুয়াদ নাসের বাবু, ওয়ারফেজ ব্যান্ডের ব্যান্ড লিডার শেখ মনিরুল আলম টিপু, আর্টসেলের লিংকন ডি কস্তা এবং কাজী ফায়সাল আহমেদ, লালনের সুমি, এফ মাইনরের পিংকি, দলছুটের সাহান প্রমুখ। টিপু বলেন, বর্ষবরণের র‌্যালিতে পৃথিবীর শান্তি কামনায় গাইবেন শিল্পীরা।

ফারুকী বলেন, ফিলিস্তিনে যা হচ্ছে, এ সময় দাঁড়িয়ে আমরা যদি শুধু আমাদের দেশের শুভকামনা করি, তাহলে এরচেয়ে স্বার্থপরতা আর কিছু হতে পারে না। ফলে ফিলিস্তিনে যা ঘটছে, এই নববর্ষে তার প্রতিবাদ করে যেন শান্তি ফিরে আসে এই কামনাটাও আমাদের করতে হবে। তাহলেই বোঝা যাবে আমরা অন্যের জন্য ভাবছি। আমাদের সংস্কৃতিটা কী, এইটা তারও একটা স্টেটমেন্ট।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় অনুষদের ডিন আজহারুল ইসলাম চঞ্চলের কাছে চাওয়া হয় মঙ্গল শোভাযাত্রার নামকরণ পরিবর্তন হওয়া না হওয়া নিয়ে। এ বিষয়ে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে আগামী ১১ এপ্রিল বেলা ১১টায় চারুকলা অনুষদের লেকচার থিয়েটার হলে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আমাদের সিদ্ধান্ত আমরা জানিয়ে দেব।

শোভাযাত্রায় প্রদর্শিত হবে ‘ফ্যাসিবাদী প্রতিকৃতি’ : শোভাযাত্রার নামকরণ চূড়ান্ত না হলেও থেমে নেই শোভাযাত্রার প্রস্তুতি। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্মিলিতভাবে কাজ করতে দেখা গেছে। শোভাযাত্রার সামনে এবার প্রদর্শিত হবে ‘ফ্যাসিবাদী প্রতিকৃতি’। থাকবে শেখ হাসিনার ‘ফ্যাসিবাদী মুখাবয়ব’। থাকবে জাতীয় পশু বাঘ, লোকজ মোটিভের কবুতর, পালকি ইত্যাদি।

মুগ্ধর পানির বোতলকে জুলাই আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করতে কাজ করছেন শিল্পীরা। আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতি তুলে ধরতে ১৫ ফুট বিশিষ্ট বোতলটির ভেতরে রাখা হচ্ছে আরও অনেক রকম খালি বোতল।

জানা গেছে, এবার শোভাযাত্রা চারুকলা, শাহবাগ, টিএসসি হয়ে শহীদ মিনারের দিকে যাবে। দোয়েল চত্বর, বাংলা একাডেমি হয়ে আবার চারুকলায় এসে শেষ হবে। কিংবা শাহবাগ দিয়ে বের হয়ে হাইকোর্ট হয়ে শিশু একাডেমি হয়ে দোয়েল চত্বর থেকে বাংলা একাডেমি হয়ে আবার চারুকলায় এসে শেষ হতে পারে। এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে শিগগিরই।

ছায়ানটে মহড়া : বর্ষবরণের অন্যতম আকর্ষণ রমনার বটমূলে ছায়ানটের সুরের মূর্ছনা। ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ প্রতিপাদ্যে এবারও আয়োজন করবে এই বৃন্দ-আয়োজন। ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনের রমেশ চন্দ্র দত্ত স্মৃতি মিলনায়তনে পুরোদমে চলছে সম্মেলক গানের মহড়া। মেঝেতে মাদুর পাতা। সম্মেলক দলের শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা বসে একের পর গেয়ে যাচ্ছিল, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’, ‘মোরা সত্যের পরে মন আজি করিব সমর্পণ,’ ‘জয় হোক তব জয়’ গানগুলো। মহড়ার পরিচালনা করেছেন ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক শিল্পী লাইসা আহমদ লিসা।

এবার অনুষ্ঠানে শতাধিক শিল্পী অংশ নেবেন। তাদের মধ্যে শিশু-কিশোরের সংখ্যাই থাকবে বেশি। বিশিষ্ট শিল্পীদের কণ্ঠে থাকবে একক গান, পাঠ ও আবৃত্তি। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০টির মতো পরিবেশনা থাকবে। তবে সংখ্যা চূড়ান্ত করা হয়নি।

রমনার বটমূলে নববর্ষের সকাল ৬টা ১৫ মিনিটে অনুষ্ঠান শুরু হবে সুপ্রিয়া দাসের পরিবেশনায় ভোরের রাগসংগীত দিয়ে। একক শিল্পীদের মধ্যে থাকবেন খায়রুল আনাম শাকিল, চন্দনা মজুমদার, লাইসা আহমদ লিসা, আবুল কালাম আজাদ, সেঁজুতি বড়ুয়া, সুমন মজুমদার প্রমুখ। আবৃত্তি করবেন জয়ন্ত রায়। অনুষ্ঠান বিরতিহীনভাবে চলবে দুই ঘণ্টা।

এদিকে রমনার বটমূলে মঞ্চ তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। মঞ্চে চূড়ান্ত মহড়া হবে ১৩ এপ্রিল রবিবার বিকালে। এবার অনুষ্ঠানে পুরুষের পোশাক থাকবে সাদা পায়জামা ও মেরুন পাঞ্জাবি আর নারীদের মেরুন পাড়ের অফহোয়াইট শাড়ি।