আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ছাড় দেবে না সরকার

সাজ্জাদ মাহমুদ খান
০৯ এপ্রিল ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ছাড় দেবে না সরকার

আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা দেখছেন রাজনৈতিক নেতারা। বিশেষ করে ভাঙচুর-লুটপাটের মতো ঘটনায় র‌্যাব-পুলিশের ব্যর্থতাকে দায়ী করা হচ্ছে। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধীদের গ্রেপ্তারে আরও কঠোর হচ্ছে সরকার। ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে সোমবার দেশজুড়ে বিক্ষোভ চলাকালে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও লুটপাটকারীদের গ্রেপ্তারে সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে ৫৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভিডিও ফুটেজ ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক জোনসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। লুটপাটকারী, চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তার করে অপরাধীদের কঠোর বার্তা দিতে চায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আগামী পহেলা বৈশাখ ও ‘মার্চ ফর গাজা’য় মতো বিশাল জনসমাগমে নাশকতা ও বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, পহেলা বৈশাখের নিরাপত্তায় কঠোর নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হবে, তবে কোনো নিরাপত্তা হুমকি নেই।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে বিনিয়োগ সম্মেলন চলছে। বিদেশি ব্যবসায়ীরা দেশে অবস্থান করছেন। বিনিয়োগের পরিবেশের জন্য আইনশৃঙ্খলা একটি বড় ইস্যু। এ সময় বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা সরকারের জন্য চরম বিব্রতকর। সরকার তাই কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তবে সোমবার ইসরায়েলবিরোধী মিছিল থেকে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায় আছে। এ ধরনের বড় জনসমাগম থেকে হামলা হতে পারে, বিষয়টি প্রতিরোধে তাদের পূর্বপ্রস্ততি ছিল না। হামলা যখন হয় তখনও তারা পুরোমাত্রায় প্রতিরোধ করেনি। ফলে নির্বিঘেœ হামলা ও লুটপাট চালানো হয়েছে। একাধিক রেস্তোরাঁর মালিক জানিয়েছে, ভাঙচুর ও লুটপাট ঠেকাতে পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল। আশপাশে পুলিশ থাকলেও প্রতিরোধ করেনি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সরকারের ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা এখানে লক্ষণীয়। সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের উচিত ছিল আগে থেকেই এখানে সতর্কতা নিশ্চিত করা। তাহলে দেশের নামে এই বদনাম আমাদের হতো না।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, যেটা ঘটে গেছে এবং যারা ঘটিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। এর সঙ্গে যারা জড়িত, ইতোমধ্যে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সেই বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, পহেলা বৈশাখ উদযাপনে রমনার বটমূল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শোভাযাত্রা, হাতিরঝিল ও রবীন্দ্র সরোবরের অনুষ্ঠানের নিরাপত্তায় বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। শোভাযাত্রার আগে ও পিছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকবে। বাইরে থেকে শোভাযাত্রার ভেতরে ঢুকে যাতে কোনো ধরনের অপরাধ ঘটাতে না পারে সেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দেশের বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপারকে নিরাপত্তার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

গত সোমবার ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার প্রতিবাদ এবং ফিলিস্তিনের মানুষের প্রতি সংহতি জানিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় মিছিল ও সমাবেশ হয়। এসব কর্মসূচি থেকে কয়েকটি জেলায় কেএফসি, পিৎজা হাট, বাটাসহ এক ডজনের বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, গত সোমবার গাজার মানুষের প্রতি সংহতি জানিয়ে দেশের বিভিন্ন শহরের প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘিরে সহিংসতা ও বেআইনি ঘটনায় পুলিশ দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে। ওই সব ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার

করা হয়েছে। এরই মধ্যে দুটি মামলা করা হয়েছে। এ ঘটনায় তদন্ত চলমান এবং জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

পুলিশ জানায়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও লুটপাটের ঘটনায় বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও দেখে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে বিভিন্ন মামলার আসামিও রয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেছেন, পহেলা বৈশাখ নির্বিঘেœ উদযাপন ও ‘মার্চ ফর গাজা’ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করা আগামী কয়েক দিনের জন্য পুলিশের প্রধান চ্যালেঞ্জ। পুলিশ নাশকতা ও বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি, টহল জোরদার এবং গোয়েন্দা নজরদারি আরও বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইউনিফর্মধারী পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য মোতায়েন করা হবে। রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকা, গুরুত্বপূর্ণ স্থানসহ দেশের অন্যান্য বড় শহর ও বন্দরে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও র‌্যাবের টহল বৃদ্ধি করতে হবে। আগামী শনিবার প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট বাংলাদেশের আয়োজনে ‘মার্চ ফর গাজা’ শিরোনামে বিক্ষোভ সমাবেশ ও গণজমায়েতে যাতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি না হয়, সেদিকে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ সমাবেশ থেকে ভাঙচুর, লুটপাট ও কূটনৈতিক এলাকায় যাতে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা না ঘটে, সেভাবে নিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে।

খুলনায় গ্রেপ্তার ৩১ : গাজার জনগণের প্রতি সংহতি জানিয়ে নগরীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ সমাবেশ করার সময় খুলনার বাটার শো রুম এবং কেএফসি রেস্টুরেন্টে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় ৩১ জনকে আটক করেছে পুলিশ। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) গণমাধ্যম শাখার এডিসি আহসান হাবিব বলেন, গত সোমবার খুলনা শহরে বাটা শোরুম ও কেএফসি ফুডকোর্টে লুটপাটের ঘটনায় পুলিশ ৩১ জনকে আটক করেছে। ভিডিও ফুটেজ ও সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে জড়িত অন্যদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আটকৃকতের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।

সিলেটে লুটের পণ্য অনলাইনে বিক্রির চেষ্টা : তৌহিদি জনতার ব্যানারে আয়োজিত মিছিল থেকে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় মামলা হয়েছে। হামলা ও লুটপাটের শিকার কেএফসি কর্তৃপক্ষ সিলেট মহানগর কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি মামলা দায়েরের পর মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ১৭ জনকে আটক করা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমের ছড়ানো ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া অনলাইনে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। লুটপাটকারীরা অনলাইনে বিভিন্ন পণ্য বিক্রির চেষ্টা করছে।

এসএমপির কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউল হক জানান, বাটার শো-রুমে হামলার পর লুণ্ঠিত জুতা ফেসবুকে পোস্ট করে বিক্রির চেষ্টা করছিলেন মামুনুল হক নামের একজন। ক্রেতা সেজে মঙ্গলবার ভোররাতে নগরের শিবগঞ্জের সাদিপুর এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়েছে। আটক মামুনুল সাদিপুর এলাকার আব্দুর রহিমের ছেলে।

মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (উত্তর) মো. শাহরিয়ার আলম জানান, লুটপাটকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে অভিযানের সঙ্গে অনলাইনে নজরদারিও চলছে।

গাজীপুরে গ্রেপ্তার চার : গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকায় গত সোমবার তৃপ্তি হোটেল, রাঁধুনী হোটেল এবং বাটা কোম্পানির ডিলারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নাশকতা, ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথ অভিযানে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

কক্সবাজারে গ্রেপ্তার ১ : কক্সবাজারে সোমবার বিক্ষোভ মিছিল চলাকালে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে হামলাও ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ একজনকে আটক করেছে। এ ঘটনায় তিন শতাধিক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইলিয়াস খান জানিয়েছেন, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির নাম মো. হাসিম। তিনি কক্সবাজার শহরের সুগন্ধা পয়েন্ট এলাকার গ্র্যান্ড মেজবানি হোটেলের কর্মচারী। রেস্টুরেন্টে হামলার ঘটনার সময়কার ছবি ও ফুটেজ থেকে শনাক্ত করার পর হাসিমকে গ্রেপ্তার করা হয়।

{প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সিলেট ব্যুরো এবং খুলনা, গাজীপুর ও কক্সবাজার প্রতিনিধি}